Type Here to Get Search Results !

   Choose Your Language   

প্রণব-নাদ কি?, What is universe sound, sound of silence,



 ভক্তির সঙ্গে জড়িয়ে নেওয়া দরকার নিজের স্বরূপের অনুসন্ধান। আচার্য শঙ্কর নিজের স্বরূপ অনুসন্ধানকে ভক্তি নামে অভিহিত করেছেন, স্ব - স্বরূপ - অনুসন্ধানং ভক্তি - ইতি - অভিধীয়তে। ঈশ্বরের প্রতি প্রেম বা ভক্তি কিংবা আধ্যাত্মিককতার পথে এই যে আমাদের অনুসন্ধিৎসা সব আসলে নিজেকে জানা। নিজেকে না জানলে ঈশ্বরকে জানা কখনও সম্ভব নয়।


 ভক্তিশাস্ত্রের দুই দিকপাল হলেন আচার্য নারদ ও শাণ্ডিল্য। দু'জনই ভক্তিসূত্র লিখেছেন। নারদীয় ভক্তিসূত্রে দেবর্ষি নারদ বলছেন, ঈশ্বরের প্রতি পরম যে প্রেম আমাদের, সেটা হল ভক্তি, সা তু অস্মিন্ পরমপ্রেমরূপা। অর্থাৎ নিঃস্বার্থ আত্মনিবেদনের কথাখানা ঘুরিয়ে বলা হচ্ছে। নিজের প্রতি যদি নিজের খোঁজ না থাকে, স্ব - স্বরূপকে আমরা যদি ধরতে না পারি তাহলে ভক্তির অনুসন্ধান করব কী করে, অর্থাৎ ভক্তি হৃদয়ে জাগ্রত হবে কী করে? ভক্তি তো ইহজাগতিক সম্পত্তি নয়, ভক্তি হল অন্তরের অন্তস্থলে সুপ্ত হয়ে থাকা সৎস্বরূপের জাগ্রতি।


 নিজের স্বরূপ যদি একবার জেগে যায়, পরমাত্মা বা ঈশ্বরের খোঁজ সহজ হয়ে ওঠে। খোঁজার যে ঐকান্তিক অনুরাগ আর নিষ্ঠা সেগুলোও ভক্তি। খুঁজতে খুঁজতে আমি তাঁর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এই রকম অনুরাগকে ভক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ভক্তিশাস্ত্রের আরেক আচার্য মহর্ষি শাণ্ডিল্য। তিনি বলছেন, ঈশ্বরে যে পরম অনুরাগ আসছে আমাদের, সেটা হল গিয়ে ভক্তি, সা পরানুরক্তিঃ - ঈশ্বরে।


 ভক্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছে হৃদয়বৃত্তি। মনটাকে সেজন্য সবার আগে জাগাতে হবে। মন জাগলে স্বরূপ অনুসন্ধানের দিকে এগিয়ে যেতে পারব আমরা। তখন মার্গীয় গুরু, শাস্ত্রীয় পণ্ডিত, আধ্যাত্মিক ভাবচর্চার অনুসারীদের সঙ্গে আমাদের ওঠাবসা শুরু হবে। একে বলা হচ্ছে সাধুসঙ্গ। সাধুসঙ্গ না হলে আধ্যাত্মিক জাগরণ হবে না। সাধুর কাছে গেলে তিনি স্বরূপ অনুসন্ধানের পথখানা বলে দেবেন আমাদের। স্ব - স্বরূপ বা নিজেকে নিজের খুঁজে পাওয়ার ভেতর দিয়ে শুরু হবে তখন আমাদের আধ্যাত্মিক পরিক্রমা। তার জন্য সাধুসঙ্গ, গুরুসঙ্গ দরকার। গুরু না হলে আধ্যাত্মিক পরিক্রমা শুরু হবে না।


যিনি মন্ত্রদাতা তিনি হলেন গুরু। মন্ত্রটি হল পরমগুরু। গুরুর দেওয়া বীজমন্ত্র যদি আমরা জাগাতে শিখি তবে জ্যোতি নাদরূপিণী জাগ্রতা কুণ্ডলিনীর শক্তিদশা টের পেতে শুরু করব। কুণ্ডলিনীকে সেজন্য সাধুগুরুরা পরাপরগুরু হিসেবে দেখেন। কুণ্ডলিনীর শক্তিদশা যখন শান্ত, চুপ, অতীন্দ্রিয় বোধে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায় শেষমেষ, সেটা হল গিয়ে শিব, শিববৎ শূন্যতা। তার মাঝে ঈশ্বর বা পরমাত্মার প্রকাশ। এজন্য সাধুগুরুরা বলে থাকেন, শিব হলেন পরমেষ্টিগুরু।


স্ব - স্বরূপে আসা মানে মন্ত্র জেগে গেছে। মন্ত্র জপ করতে করতে নাদ জ্যোতিরূপে আত্মা অন্তরে প্রকাশিত হয়ে ওঠে। আত্মা জাগলে আত্মদর্শন আসে। গুরু যদি কৃপা করে মন্ত্র দেন আর জপ করার কৌশলগুলো দেখিয়ে দেন তখন মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে মন্ত্রের প্রথম শরীর জেগে ওঠে। মন্ত্রের শরীর হল গিয়ে স্ব - স্বরূপ। নিজের ভেতর বীজমন্ত্র জেগে উঠলে জ্যোতিনাদ আসে। সেটা হল দ্বিতীয় দেহ। আধ্যাত্মিক রাজ্যে যেতে গেলে এই দেহটি সবার আগে দরকার। গুরু যখন মন্ত্র দেন তখন শিষ্যর দেহটি গুরুর হয়ে যায়। নিজের বলে তখন আর কিছু থাকে না। গুরুর দেহ, গুরুর মন্ত্র এমন ভাবনা এলে গুরুর স্বরূপ নিজের ভেতর হঠাৎ করে জেগে উঠে জগৎ গুরুময় হয়ে পড়ে। তখন শুরু হয় আধ্যাত্মিক পরিক্রমা।


পরিক্রমার জন্য অতীব দরকারি হল গিয়ে মন। অস্থির মন নিয়ে পরিক্রমা করা যায় না। দরকার স্থির মন। মন স্থির হবে একমাত্র তখন দেহে যখন সত্ত্বগুণ বেড়ে চলে। সত্ত্বগুণ বাড়তে পারে সাধুসঙ্গে, গুরুসঙ্গে। এই হল গিয়ে সবচেয়ে সহজ উপায় স্ব - স্বরূপকে খুঁজে পাওয়ার।


 গুরু যে মন্ত্রটি দিয়েছেন তা হল শব্দব্রহ্ম। মুখ দিয়ে প্রথমে আমরা যে জপ করি, বাচিক জপ --- তা হল  বৈখরী। শব্দব্রহ্মের চার অবস্থা থাকে আমাদের দেহে। দেহ যখন গুরুর হয়ে যায়, শিষ্যর দেহের সমস্ত কলকব্জা যখন গুরুগত তখন গুরুর ছোঁয়া পেয়ে দেহের মূলাধারে পরা শব্দ জাগে। মুখে যে শব্দ, গুরুর দেওয়া জপমন্ত্র তা হল বৈখরী। বৈখরীতে জপ করতে করতে হৃদয়ে আসতে হবে। এখানে স্থিতির ভেতর মধ্যমা বাক্ বা গুরুমন্ত্র জেগে উঠবে কীরকমভাবে জপের কৌশলে তা গুরুদেব দেখিয়ে দেন। হৃদয় থেকে জপমন্ত্র যখন নাভিতে সঞ্চারিত হবে তখন পশ্যন্তী বাক্ জেগে উঠবে। নাভি থেকে জপমন্ত্রের স্থিতি আসবে মূলাধারে। এখানে রয়েছে পরা বাক্। শব্দব্রহ্মের চার অবস্থা দিয়ে জপ করা প্রথমে শিখতে হবে।


বৈখরীতে জপ করতে করতে হৃদয়ে, মধ্যমাতে ডুব দিতে হবে। সাধুগুরুরা বলেন, হৃদয়ে আছে অনন্ত শব্দ। তখন আর জপ করতে হয় না, আপনা আপনি বীজমন্ত্র মধ্যমা থেকে স্বতঃ উঠতে থাকে। সাধুগুরুরা একে বলেন নাদব্রহ্ম। জপের ভেতর নাদ শুনতে পাওয়ার কৌশলগুলো আছে দেহতে সুপ্ত। গুরু যখন শিষ্যর দেহ জাগিয়ে দেন তখন বৈখরীতে জপ করতে বসে শিষ্য নাদের আওয়াজ টের পেতে থাকে, নাদ কোটি সহস্রাণি।


কোটি সহস্র নাদের আওয়াজ আছে। শিষ্য কোন আওয়াজ পাবে সেটা গুরুমন্ত্রের ওপর নির্ভর করে। মন্ত্র যখন মধ্যমা পেরিয়ে নাভিতে, পশ্যন্তীতে গিয়ে পৌঁছয়, জ্যোতি চলে আসে। একসময় সুষুম্নার মুখ খুলে গিয়ে শেষমেষ মন্ত্রের লয় হয়ে যায়, মন্ত্র তখন আর জপ করতে হয় না। দেহ নাদময় হয়ে ওঠে। পরায় গিয়ে এরপর একেবারে স্থিতি। শিষ্য তখন সাধক দশাতে চলে যান।


 বীজমন্ত্র জপ করা হল গিয়ে মন্ত্রযোগ। বীজ জপ করতে করতে বায়ু যখন জমাট বেঁধে যায় তখন আলো জ্বলে ওঠে অর্থাৎ হঠাৎ করে জ্যোতি আসে। এটা হঠযোগ। স্ব - স্বরূপে না গেলে জ্যোতির অনুধাবন আসবে না। জ্যোতি যখন বিন্দুনাদ হয়ে গিয়ে নেচে নেচে সাধকের গোটা দেহে খেলে বেড়ায় তখন লয়ের দশাপ্রাপ্তি আসে। এটা হল গিয়ে লয়যোগ। আর যখন দেহবোধ একেবারে নিষ্পন্দ, কোনও আওয়াজ নেই নাদের সেটা রাজযোগ। নাদব্রহ্মের চূড়ান্ত দশা। জগতে তখন সমস্ত চঞ্চল একমাত্র আমার দেহ স্থির।


 স্থির দেহ আমার স্বরূপ। স্ব - স্বরূপে জেগে উঠেছেন ভগবান। গুরু, মন্ত্র, ইষ্ট তখন সব একাকার। এক দেখা অভ্যাস করতে শিখতে হবে। তোমার গুরু আমার গুরু, তোমার পরম্পরা আমার পরম্পরা, তোমার শ্যামা আমার শ্যাম এই বোধগুলো যখন চলে গিয়ে সব এক হয়ে ওঠে তখন স্ব - স্বরূপ আসে। জ্যোতি আর নাদের আওয়াজ --- অনাহত ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। এই ধ্বনি যাঁরা একবার শুনেছেন তাঁদের আর কোনও ভেদ থাকে না। কে শাক্ত কে বৈষ্ণব, কে শ্রীকৃষ্ণ কে মহামায়া সমস্ত তখন অনাহতের সাড়া। এমন মানুষজনের সন্ধান পেলে তাঁদের কাছে গিয়ে সঙ্গ করতে করতে একসময় স্ব - স্বরূপে চলে আসা যায়।


 স্ব-স্বরূপে গেলে ভ্রুমধ্যে চোখ বুজে ধ্যান করতে করতে নাদ শোনা যায়। জপ করা যায়। ভ্রুমধ্যে তখন সমস্ত আশ্রয়। একে বলা হয় মৃত্যুঞ্জয়ী ক্রিয়া। এই ক্রিয়া জপপ্রণালীর সবচেয়ে ফলদায়ক অধ্যায়। এখানে যেতে পারলে আত্মদর্শন, আত্মজ্ঞান, আত্মদৃষ্টি আর সমদৃষ্টি।


 সমদর্শন এলে যখন মন্ত্রযোগ চলছে তখন একবার বিগ্রহে লক্ষ্য থাকে। তারপর মূর্তি সরে যায়। তখন জ্যোতি --- ধ্যেয় জ্যোতি, হঠযোগ। যখন জ্যোতির লয় তখন নাদ ও বিন্দু সব একাকার। শান্তকামী হয়ে কেবল স্ব - স্বরূপে লক্ষ্য থাকে। নাদ যখন শেষ জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায় তখন সেটা মেঘনাদ।

নাদের আওয়াজ প্রথমে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকের মতন আসে। তারপর বাঁশি, ঘণ্টা ইত্যাদি। নাদের বহু রকম আওয়াজ আসে, নাদকোটিসহস্রাণি।


সাধুগুরুরা সব নব নাদের কথা বলেন। নাদের শেষ হয় মহানাদে। বৈদিক সাধনক্রমে মহানাদ। উপনিষদাদিতে এর উল্লেখ আছে। শিবপুরাণ আবার শেষ নাদ হিসেবে চিহ্নিত করছে ওঙ্কারকে। শিবপুরাণে শেষ নাদ ওঙ্কার নাদ। পাতঞ্জল যোগদর্শনেও মেঘনাদ হল গিয়ে শেষ নাদ।


 নাদ শুনতে শুনতে নানান অলৌকিক শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ চলে আসে। বাইরের সাড়াগুলো যখন সরে তখন ভেতরের সাড়া মেলে। এখানে দ্রষ্টাভাব আসে সাধকের। দর্শনের আকাঙ্খা জেগে ওঠে। পশ্যন্তীতে গিয়ে দর্শনাদি হয়। তারপর শেষ অবস্থা পরায় গিয়ে সব একাকার হয়ে যাবে। যখন আত্মজ্ঞান, পূর্ণজ্ঞান আসবে, চোখ খুললেও জ্যোতি, বন্ধ করলেও জ্যোতি। লাল জ্যোতি, নীল জ্যোতি। রজঃগুণের জ্যোতি হল লাল। নীল জ্যোতি তমঃগুণের আর শেষ জ্যোতি শ্বেত জ্যোতি হল সত্ত্বগুণের। এখানে স্ব - স্বরূপ। নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়। এখান থেকে শুরু হবে আমাদের সাধনা।


সোমব্রত সরকার 

Tags

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.