নির্বিকল্পসমাধিঃ---
কামাক্ষা মন্দিরে তখন স্বামী নিত্যানন্দ নামে জনৈক সাধুর সঙ্গে নিগমানন্দের আলাপ হয়েছিল। একদিন নিগমানন্দ তাকে বললেন যে তিনি বেদান্তের নির্বিকল্প সমাধিতে যাবেন কারন তখন তার এই বিষয়ের অনুভুতি সহজসাধ্য হয়ে গেছে। নিত্যানন্দ তাকে এরূপ সমাধিতে গেলে কেউ ফিরে না এই সতর্ক বাণী শুনিয়েছিলেন। তার কথায় না হঠে- কামাক্ষা পাহাড়ে ভুবনেশ্বরী মন্দিরের পশ্চিম দিকে বর্তমান ডাকবাঙ্গলোর পিছনে অথাৎ উত্তর দিকে যে রাস্তাটি নেমেছে, তারই বায়ে সরে নিন্ন স্থানে গিয়ে একটি নির্জন স্থান নিদ্দিষ্ট করে নিলেন। নিগমানন্দ নিশ্চিত হলেন- যেন কেউ বিঘ্ন ঘটাতে না পারে। তারপর একদিন সকাল সকাল পাক করে খেয়ে পাহাড়ে গিয়ে পূর্বনিদ্দিষ্ট স্থানে বসে, যা থাকে কপালে, থাকে প্রাণ আর যায় প্রাণ, যা হয় হবে- ভেবে নির্বিকল্পে ওঠার ঠিক করলেন। মনে ভয় ছিল, বোধ হয় ফরা হবে না।
![]() |
নিগমানন্দ ঠাকুরের সাথে কথালাপ স্বামী নিত্যানন্দ |
ঠাকুরের কথাতেই বলি- বসে ধ্যানস্থ হলাম।ধ্যানে প্রথমতঃ আমিত্বের প্রসার করতে লাগলাম। ক্রমে সেই আমিত্বকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিলাম। সমস্ত জগতটাই আমি। ঐ দিন নিদিধ্যাসনে বসেছিলাম, কাজেই আমিত্ব প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মনও উদ্ধোজগতে উঠতে লাগল। উঠবার সমায় দেখি একটা আলো, সেটা অল্প জ্যোতি, এরপর আর একটু উঠে আর একটা আলো, এটা তার চেয়ে একটু বেশী জ্যোতি এই রূপে ক্রমশ উঠতে লাগলাম। সঙ্গে সঙ্গে মনে হতে লাগল যেন একটা একটা দুয়ারের কপাট খুলে যাচ্ছে। শেষে সমস্ত লোক পার হয়ে জ্যোর্তির্ময় মন্ডলে এস পড়লাম। এই জ্যোতির মধ্যে আমি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লাম, অনন্ত জ্যোতিতে আমিত্বের প্রসারে আমার নির্বিকল্প সমাধি লাভ হল।
এবার আর তো কিছু বলতে পারছি না, ফুরাইল বাক মোর- ভাবটা মনে আসছে কিন্তু তোমাদের বোঝাতে পারছি না…না আর বলতে পারলাম না। তারপর যে কী অবস্থা হল, তা বুঝাবার মত ভাষা আর নেই। সেদিন যে ফিরব সেও আশা করে বসি নাই, কারন নির্বিকল্প সমাধিতে গেলে মানুষ আর ফেরে না। কতক্ষন যে এরূপ ছিলাম জানি না, কিছুক্ষন পরে হঠাৎ একটা দৃঢ় সংকল্প জাগল- আমি গুরু। মুহুত্ব মধ্যে ঐ অনন্ত জ্যোতি কেন্দ্ররূপী একটি বিন্দুর আকার ধারন করল। তার উদ্ধে আর কেউ নাই। সেই বিন্দুই আমি। আমার উদ্ধে আর কিছুই নাই। সেই বিন্দুই আমি। আমার উপরে আর কিছুই নাই। ঐ কেন্দ্রবিন্দুই গুরু, আর ঐ গুরুই আমি। এই গুরুসত্তা ছাড়া আর আমার কোন সত্তাই থাকল না। ‘আমি গুরু’- শুধু এই ভাবটিই পরিপুষ্ট হতে লাগল।
হঠাৎ দেখি ঘোর অন্ধকার, এই অন্ধকার রাজ্যে কেমন করে এলাম জানি না। এখন বের হই কেমন করে? বের হবার পথ তো কিছুই নাই। জানি না পরমেশ্বরের কি ইচ্ছা! কিছুক্ষন পরে হঠাৎ দেখি কতগুলো ছিদ্রবিশিষ্ট একটা জালের মত জ্যোতির্ময় পদার্থ জ্বল জ্বল করছে। ঠিক তার মাঝখানে একটা ছিদ্রের প্রতি আমার দৃষ্টি পড়ল। সেটা ক্রমে বড় হতে লাগল। আমি তার মধ্যদিয়ে গ’লে পড়লাম। কিন্তু গ’লে পড়বার সমায় গর্ভযন্ত্রনার মত যন্ত্রনা হল। এই রূপে ক্রমশঃ র্নিগুন হতে সগুণের অবস্থা আসতে লাগল। তারপর সত্য, প্রভৃতি লোকগুলি ফুটে উঠতে লাগল। শেষে যখন ভুলোকে পড়লাম, তখন সমগ্র পৃথিবীটা আমার দৃষ্টির মধ্যে এসে পড়ল। হঠাৎ ভারতবর্ষটা আমার দৃষ্টির মধ্যে আসল। অন্যান্য বড় বড় দেশ মহাদেশগুলিও বেশ দেখতে লাগলাম। তারপর আসাম দেশ, শেষে কামাক্ষা পাহাড়, ব্রক্ষ্মপুত্র নদী আর পাহাড়স্থ বৃক্ষলতা আমার দৃষ্টিতে এল। ক্রমশঃ মন্দিরটি দেখতে দেখতে নিজের দেহটা হঠাৎ দৃষ্টিতে পড়ল। আমি অমনি দেহের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। কিন্তু কোন মুহুত্বে কি করে যে দেহে ঢুকলাম, তা বুঝতে পাড়লাম না। আর বেড় হওয়ার সমায় যে কি রূপে বেড় হয়েছি, তাও বুঝতে পারি নাই। যেই দেহে ঢুকলাম তখন আমার জ্ঞান হ’ল আমি অমুক, কিন্তু আমি গুরু- এই বিশেষ জ্ঞান নিয়ে আমার বুত্থান হল। নির্বিকল্পের জ্ঞান নিয়ে যে জ্ঞানমাগী সাধক ব্যুত্থিত হন, তিনি ব্রক্ষ্মবেত্তা, সুতরাং ব্রক্ষ্ম হয়ে যান। তিনিই সদগুরু।
জ্ঞানীগুরু সচ্চিদানন্দ ও যোগীগুরু সুমেরদাসজীর ভবিষ্যদ্বাণী নির্বিকল্প আপসে আ যায়েগা- আজ বাস্তবে পরিনত হল। শরীরে কোনও ক্লান্তি নেই। নিত্যানন্দ স্বামী তার অপুর্ব জ্যোর্তিময় মূর্তি দেখে আচার্য হয়ে গেলেন। তার মুখ সর্বদা জ্যোর্তিময় হয়ে থাকত, চোখ দিয়ে জ্যোতির ঝলক বেরুত আর রশ্মি বাইরে পর্যুন্ত দেখা যেত। জগদগুরুর ইচ্ছাই তার মধ্যে লীলায়িত হয়ে উঠল।
নির্বিকল্পসমাধি- বুত্থিত নিগমানন্দের মন প্রাণ তৃপ্তিতে ভরে গেল। এই মহতী প্রাপ্তির সুসংবাদ গুরুর চরণে নিবেদন করার জন্য তিনি পশ্চিমে যাত্রা করলেন ।