Type Here to Get Search Results !

   Choose Your Language   

A. C. Bhaktivedanta Swami Prabhupada Biography Bengali | Iskcon , অভয়চরণাবৃন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ জীবন,

 অভয়চরণাবৃন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ



অসংখ্য নরনারী তাকিয়ে আছেন তার মুখের দিকে। শান্ত সমাহিত

তনুবাহার। ভারতীয় ঋষির মতাে চেহারা। উচ্চারিত হচ্ছে মহামন্ত্র। সেই

মন্ত্রে উজ্জীবিত হচ্ছেন জনতা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর আগে আরও অনেক ভারতীয় বৈদান্তি সন্ন্যাসী

এসে চিরন্তন ভারত-সভ্যতার কথা বলেছেন। এসেছেন স্বামী বিবেকানন্দ,

স্বামী অভেদানন্দ, আরও কতজন। তাঁদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে এলেন

ভক্তিবেদান্ত স্বামী।

ঊনসত্তর বছর বয়সে পরম বৈষ্ণব সন্ন্যাসী হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের

মহাপ্রদীপ জ্বাললেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তুে তিনি মার্কিন দেশের উদ্ভ্রান্ত

ভােগ সর্বস্ব যুবক-যুবতীদের ডাক দিয়ে বললেন—অপার্থিব আনন্দ এবং

দিব্যভাব কখনােই জড় অনুভূতির দ্বারা উপলব্ধি করা যায় না। এই অনুভূতি

ভাষায় প্রকাশ করা অত্যন্ত কঠিন। তবে এই দিব্যানুভূতি পাওয়ার একমাত্র

উপায় হল মহানাম হরে কৃষ্ণ নাম সংকীর্তন করা। এই মহানাম জপ ও

কৃষ্ণ নাম কীর্তনের মাধ্যমে সমস্ত চেতনার উৎস পরমেশ্বর ভগবান কৃষ্ণের

সান্নিধ্যে জড় অনুভূতি সম্পন্ন মানুষও চেতনামুক্ত হতে পারে। কারণ

কৃষ্ণই হচ্ছেন সমস্ত চেতনার উৎস—পরম চৈতন্য। জীব চৈতন্যের কাজ

হচ্ছে পরম চৈতন্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কর্ম করে যাওয়া। তাহলেই মানুষ

জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধির বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারবে।

তার ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার শ্বেতাঙ্গ নরনারী বিলাসী

জীবনযাত্রাকে স্ব-ইচ্ছায় পরিত্যাগ করে কৃষ্ণপ্রেমে মাতােয়ারা হয়েছেন।

তিনি মায়াপুরে স্থাপন করেছেন চন্দ্রোদয় মন্দির। তারই অনুপ্রেরণায় প্রতি বছর তার প্রতিষ্ঠিত ইস্কনের তরফে রথযাত্রা ধূমধাম সহকারে পালন

করা হয়।



ভক্তিবেদান্ত স্বামী পুরাণের বিভিন্ন ব্যাখ্যাকে সহজ সরলভাষায়

সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, “কুরুক্ষেত্রের।

রণাঙ্গনে অর্জুন বলেছিলেন, “আমি যুদ্ধ’ করব না, রাজ্য লাভের জন্য

আমি আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে কিছুতেই যুদ্ধ করব না। একজন

সাধারণ মানুষের মনে হবে অর্জুন কত ভালাে মানুষ, তিনি অহিংস।

তিনি তাঁর আত্মীয়-স্বজনের জন্য সব কিছু পরিত্যাগ করেছেন। কিন্তু কৃষ্ণ

কী বললেন? কৃষ্ণ বললেন, তুমি নিতান্তই নির্বোধ। এখন দেখুন

জনসাধারণের দৃষ্টিতে যা ভালাে, খুব সুন্দর, ভগবান তার নিন্দা করছেন।

সুতরাং আমাদের দেখতে হবে আমাদের কার্যকলাপের দ্বারা ভগবান

পরমেশ্বর সন্তুষ্ট হচ্ছেন কিনা। এখানে দেখুন, অর্জুনের কার্যকলাপ শ্রীকৃষ্ণ

অনুমােদন করছেন না। অর্জুন তার খেয়ালের বশবর্তী হয়ে ইন্দ্রিয় তৃপ্তির

জন্য প্রথমে ঠিক করলেন যে, যুদ্ধ করবেন না। এটাই হচ্ছে জড়-ইন্দ্রিয়ের

তৃপ্তিসাধন করার ভ্রান্ত প্রয়াস। কিন্তু অবশেষে শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টি বিধানের

জন্য যুদ্ধ করলেন। এইখানেই আমাদের পরিপূর্ণতা। এইভাবে যখন আমরা

পরম চৈতন্যের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য কর্ম করি, তখন আমরা আমাদের

জীবনের পূর্ণতা প্রাপ্ত হই।”

সেটা ছিল ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস। মালবাহী জাহাজে করে

প্রভুপাদ মার্কিন দেশে এলেন, সঙ্গে তিন ট্রাঙ্ক বােঝাই শ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থ।


টম্পকিনস স্কোয়ার পার্ক এলাকাতে একাই নাম সংকীর্তন করতে লাগলেন।

সময়টা ছিল ষাটের দশক। মার্কিন যুবসমাজ একেবারে দিশেহারা হয়ে

গেছে। চলেছে হিপি আন্দোলন। নেশায় বিষাক্ত হচ্ছে যৌবন। অবৈধ

স্ত্রীসঙ্গ আর ভবঘুরের মতাে সময় কাটানাে। প্রভুপাদ বিভীষিকাপূর্ণ এই

সমাজ জীবনকে প্রত্যক্ষ করে শিউরে উঠলেন। তিনি ভালােবাসা দিয়ে

এইসব তরুণ-তরুণীদের কাছে ডাকলেন। বিভিন্ন স্থানে গড়ে তুললেন

হরেকৃষ্ণ সম্প্রদায়। লােয়ার-ইস্ট সাইড অঞ্চলটি ছিল চিত্রশিল্পী এবং সঙ্গীতশিল্পীদের আড্ডাস্থল। দলে দলে সঙ্গীতশিল্পী আর হিপিরা তার

সংকীর্তনে যােগ দিতে লাগল। 


হিপিরা মনে করতে লাগল হরে কৃষ্ণ

মহামন্ত্র জপ করাটা বােধহয় আধুনিক ফ্যাসানের অঙ্গ। ধীরে ধীরে কৃষ্ণকীর্তন

আমেরিকার দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠল। এইভাবে প্রভুপাদ কৃষ্ণকীর্তনের

মাধ্যমে মার্কিন দেশের বিপদগামী তরুণ সমাজকে আবার সমাজের

মূলস্রোতে ফিরিয়ে এনেছিলেন। একজন কর্মক্ষম যুবকের মতাে কাজ

করেছেন সত্তর বছর বয়সে। প্রত্যেক দিন শ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থের ইংরাজি

অনুবাদ করতেন। নিজে রান্না করে কৃষ্ণকে নিবেদন করে প্রসাদ গ্রহণ

করতেন। গীতা, ভাগবতের ক্লাস নিতেন।নাম সংকীর্তন করতেন। তাছাড়া

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ভারতীয় দর্শনের ওপর ভাষণ দিতেন। একটি

পরিত্যক্ত দোকান ঘরে কৃষ্ণ মন্দির স্থাপন করেন, যা আজ ইস্কন নামে

সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। একজন মানুষের কর্মক্ষমতা কতখানি

হলে এইসব অলৌকিক কাজ করা যায়, তা আমরা সহজেই বুঝতে পারছি।

১৯৬৬ সালে নিউইয়র্কের সেকেণ্ড অ্যাভিনিউতে তৈরি হল

আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘ (Society for International Krishna

Consciousness) সংক্ষেপে Iscon.

১৮৮৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর ১৫১, হ্যারিসন রােডে অভয়চরণের

জন্ম হয়েছিল। তাঁর পিতা সুবর্ণবণিক বংশের সন্তান গৌরমােহন দে এবং

মা রজনীদেবী। তারা দুজনেই ছিলেন ঈশ্বর ভক্ত। পিতা ছিলেন কাপড়ের

ব্যবসায়ী। দে পরিবার ছিল ভবানীপুরের মল্লিক পরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।

মল্লিকদের বাড়িতে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ ছিল। সেখানে যাতায়াতের ফলে

বাল্যকালেই অভয়চরণ রাধাকৃষ্ণের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ওঠেন। পিতা তাকে

একটি রাধাকৃষ্ণের মূর্তি উপহার দিয়েছিলেন। বালক এই বিগ্রহের সেবায়

নিজেকে নিয়ােগ করলেন। আবার পুরীর রথযাত্রার অনুকরণে রথের

উৎসবও করতে লাগল। *

তবে পিতা তার এই কাজে বাধা সৃষ্টি করেননি। মনে মনে ভগবানের

কাছে প্রার্থনা করতেন, তাঁর পুত্র যেন রাধারানির ভক্ত হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে এই পুত্র এলাহাবাদের একজন ওষুধ ব্যবসায়ী হয়ে

উঠেছিলেন। সংসারের মধ্যে থেকেও তিনি কিন্তু সেই পেশার প্রতি আসক্তি

বােধ করেননি। ১৯২২ সালে কলকাতায় তাঁর সঙ্গে দেখা হল শ্রীল

ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গােস্বামীর। সরস্বতী গােস্বামী তাকে দেখেই বুঝতে

পেরেছিলেন যে, তার মধ্যে একটি সৎ ভাবনা লুকিয়ে আছে। পরবর্তীকালে

তিনি হয়তাে কৃষ্ণনাম সংকীর্তনে নিজেকে নিয়ােগ করবেন।

সরস্বতী গােস্বামী ছিলেন একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত তিনি ৬৪টি গৌড়ীয়

মঠের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি এই বুদ্ধিদীপ্ত, তেজস্বী ও শিক্ষিত যুবকটিকে

বৈদিক জ্ঞান প্রচারের কাজে জীবন উৎসর্গ করার জন্য অনুপ্রাণিত করলেন।

মধ্যবয়সী অভয়চরণ প্রথম দর্শনেই তাকে গুরু বলে মেনে নিয়েছিলেন।

এগারাে বছর ধরে গুরুদেবের সান্নিধ্যে থেকে বৈদিক জ্ঞান অর্জন করেন।

তারপর ১৯৩৩ সালে এলাহাবাদে দীক্ষা গ্রহণ করেন। ভগবদগীতার নানা

ধরনের ভাষ্য লিখে গৌড়ীয় মঠের প্রচারের কাজে প্রত্যক্ষভাবে যােগ

দিলেন।

একক উদ্যোগে ১৯৪৪ সালে একটি ইংরাজি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ

করতে শুরু করলেন। ইংরাজি ভাষায় ভারতীয় ধর্ম, দর্শন সম্বন্ধে প্রবন্ধ

লিখলেন। ১৯৪৭ সালে শ্রীল প্রভুপাদের দার্শনিক জ্ঞানের স্বীকৃতিতে

গৌড়ীয় বঙ্গীয় সমাজ তাঁকে ভক্তিবেদান্ত উপাধিতে ভূষিত করেছিল।

১৯৫০ সালে চৌষট্টি বছর বয়সে প্রভুপাদ সংসার জীবন ত্যাগ করে

বাণপ্রস্থাশ্রম গ্রহণ করলেন। তখন তার সময় কেটেছে শাস্ত্র অধ্যয়ন এবং

শাস্ত্র প্রচারের কাজে। বৃন্দাবনে গিয়ে রাধা-দামােদর মন্দিরে বসবাস করতে

থাকেন। তখন থেকেই শ্রীমদভাগবত ইংরাজি ভাষায় অনুবাদ করার কাজে

হাত দেন। পরবর্তীকালে শ্রীমদ্ভাগবতের ভাষ্য এবং তাৎপর্যসহ আঠারাে

হাজার শ্লোকের ইংরাজি অনুবাদ প্রকাশ করেছেন।

১৯৫৯ সালে গুরুদেবের কাছ থেকে সন্ন্যাসমন্ত্রে দীক্ষিত হলেন?

তার নামকরণ করা হল শ্রীঅভয়চরণাবৃন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ।

গুরুদেব তাকে বলেছিলেন পাশ্চাত্য দেশে গিয়ে ইংরাজি ভাষাতে শ্রীমদভাগবতের ধর্মের কথা বলতে। গুরুদেবের সেই আদর্শ শিরােধার্য

করে ঊনসত্তর বছর বয়সে এলেন আমেরিকায়।

আশ্রয় নিলেন এক ভক্তের পুত্র গােপাল আগরওয়ালের ঘরে। তাকে

আমেরিকা যাবার সুযােগ করে দিয়ে ছিলেন ভক্তিমতী রমণী শ্ৰীমতী

সুমতি মােরারজি। সেখানে ছ'মাসের জন্য প্রভুপাদ এসেছিলেন। কিন্তু

শ্রীমতি মােরারজি লিখলেন, আপনার প্রচার কার্য সম্পূর্ণভাবে সফল হলে

তবেই আপনি ভারতে ফিরে আসবেন।

এবার প্রভুপাদ মার্কিন দেশে প্রচারের কাজে নিজেকে নিয়ােগ করলেন।

এক বছর তাকে কঠোর ধৈৰ্য্য সহকারে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করতে হয়েছে।

এই কাজে তিনি কারাে কাছ থেকে কোনাে সাহায্য পাননি।

১৯৭২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে স্থাপিত হল গুরুকূল

বিদ্যালয়। এইভাবে তিনি সেখানে মাধ্যমিক এবং প্রাথমিক স্তরে বৈদিক

শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন করলেন। মাত্র তিনজন ছাত্র নিয়ে এই গুরুকূলের

যাত্রা শুরু হল। বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় তিরিশটি গুরুকূল বিদ্যালয় আছে।

১৯৭২ সালে নবদ্বীপধামের মায়াপুরে রাধাকৃষ্ণের মন্দির এবং ইস্কনের

কেন্দ্র স্থাপন করেন সেই বছরেই রাশিয়াতে গিয়ে মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের

ভারততত্ত্ববিদ পণ্ডিত কটভস্কির সাথে ভগবত ধর্ম নিয়ে আলােচনা

করেছিলেন। এই আলােচনা পরবর্তীকালে একটি পুস্তিকায় প্রকাশিত

হয়েছিল।

প্রভুপাদ চেয়েছিলেন বৈদিক সাম্যবাদ প্রচার করতে। তিনি পৃথিবীর

বিভিন্ন দেশে চোদ্দবার পরিক্রমা করেছেন। তার অসামান্য কর্মোদ্দীপনায়

মাত্র দশ বছরের মধ্যেই পৃথিবীর বড়াে বড়াে শহরে ১০৮টি কৃষ্ণমন্দির

প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

শ্রীশ্রী প্রভুপাদ অসামান্য গ্রন্থাবলী রচনা করেছেন। তাঁর রচনাশৈলী

অত্যন্ত সরল এবং প্রাঞ্জল কিন্তু গাম্ভীর্যপূর্ণ। সেজন্য বুদ্ধিজীবী সমাজে

তার বিশেষ পরিচিতি আছে। এইভাবে কৃষ্ণ ভাবনামৃত আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তিনি বিশ্বব্যাপী

এক নতুন ধর্মোম্মাদনার সৃষ্টি করেন। তিনি মানুষকে আহ্বান করে বলেন,

“ভগবান কৃষ্ণ হচ্ছেন পরম ঈশ্বর। এই পৃথিবীর আমরা সবাই তার

সেবক ছাড়া আর কেউ নই।”

এই মহাপুরুষ ১৯৭৭ সালে ১৪ নভেম্বর বৃন্দাবনের কৃষ্ণ-বলরাম

মন্দিরে ইহলীলা সংবরণ করেন। আজও পৃথিবীর সর্বত্র তার প্রতিষ্ঠিত

আশ্রমে তারই প্রদর্শিত শাশ্বত পন্থায় দেবার্চনা চলেছে। হাজার হাজার

মানুষ কৃষ্ণপ্রেমে মাতােয়ারা হয়ে পার্থিব জীবনের বিলাসকে দূরে সরিয়ে

রেখে আধ্যাত্মিক জীবন পথের পথিক হচ্ছেন। এইভাবেই তিনি

আজও সমস্যাবিদীর্ণ পৃথিবীতে বেঁচে আছেন, বেঁচে আছেন শান্তির এক

শাশ্বত প্রতীক হয়ে।


  Power by : © YogiKathaOfficial   

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.