আক্কা মহাদেবী
কন্নড় অর্থাৎ কর্ণাটকের ইতিহাসে দ্বাদশ শতাব্দী একটি গুরুত্বপূর্ণ শতক
হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এই সময় ধর্মগুরু এবং সমাজ-সংস্কারক
বাসবেশ্বরের আবির্ভাব ঘটে। আসেন আচার্য আল্লামা। তারা বীরশৈবমত
নামে একটি নতুন ধর্মের প্রবর্তন করেছিলেন। এই যুগের বিখ্যাত
জ্যোতিষ্কবৃন্দের মধ্যে আক্কা মহাদেবীর কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করা
উচিত। তিনি নিজের জীবনে যে ধর্মনীতিকে প্রত্যক্ষ করেন তাকে শরণসতী
বা লিঙ্গপতি বলা হয়ে থাকে।
আক্কা মহাদেবী কবিত্ব শক্তির অধিকারিণী ছিলেন। তার বেশ কিছু
উক্তি ভাবীকালের জন্য পাঠ্য বিষয় হিসেবে সংগৃহীত হয়ে আছে। একসময়
এই ছন্দময় গদ্য রচনাগুলি বীর শৈবপন্থীদের কাছে খুবই প্রিয় ছিল। কন্নড়
সাহিত্যের ধারাবাহিক উন্নতিতে এই রচনাবলীর দান অবশ্য স্বীকার করতে
হবে। কন্নড় ভাষায় বচন রচয়িতার সংখ্যা কম নয়। কিন্তু সকল সমালােচক
একমত যে এঁদের মধ্যে আক্কা মহাদেবীর স্থান সবার আগে। আক্কা মহাদেবীর
এই জাতীয় বচন সাহিত্যের নতুন ধারার প্রবর্তন করেছিল। পরবর্তীকালে
তাকে অনুসরণ করে অনেকে এই জাতীয় কাব্য রচনা করতে থাকেন।
তাই আজও পরম শ্রদ্ধা সহকারে আক্কা মহাদেবীর রচনা পাঠ করা হয়।
তাঁর রচনার সব থেকে বড়াে বৈশিষ্ট্য হল অন্তনিহিত দার্শনিক তত্ত্বের
প্রতিফলন। এই বচনগুলিতে আছে সুতীব্র আবেগ এবং গভীর অন্তদৃষ্টির
সংমিশ্রণ। এই আধ্যাত্মিক বচনগুলি থেকে তার জীবন ইতিহাস সম্পর্কে
অনেক কথা জানতে পারা যায়।
তিনি ছিলেন এক শিব ভক্ত দম্পতির কন্যা। তার বসবাস ছিল নগর রাজু উরুয়ারিতে। যৌবনে অসামান্যা সুন্দরী বলে বিখ্যাত হয়েছিলেন।
ওই রাজ্যে কৌশিক নামে এক রাজপুত্র বাস করতেন। একদিন তিনি
রঙ্গভূমি থেকে শােভাযাত্রা করে রাজপ্রাসাদে ফিরছিলেন। মহাদেবীকে
নিজের বাড়ির সামনে দেখতে পান। প্রথম দর্শনেই কৌশিক আত্মহারা
হয়ে যান। নিজেকে সংযত করতে না পেরে হাতিকে সেখানে থামতে
নির্দেশ দেন। শােভাযাত্রা সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায়। মহাদেবী তার শোভাযাত্রা
দেখছিলেন। যখন তিনি লক্ষ্য করলেন যে, কৌশিক তার দিকে তাকিয়ে
আছেন, তিনি দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। কৌশিক তাকে
দেখতে পেলেন না। কিন্তু হৃদয়ে তার মূর্তি আঁকা হল। কোনােরকমে
পারিষদবৃন্দ কৌশিককে প্রাসাদে ফিরিয়ে আনলেন। কৌশিকের মনের
অবস্থা তখন ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। মন্ত্রীরা মহাদেবীর পিতার কাছে
গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। তারা কৌশিকের অবস্থার বর্ণনা দিলেন। এ
কথাও জানালেন যে, রাজার ইচ্ছের বিরুদ্ধাচরণ হলে আর রক্ষা নেই।
মহাদেবীর মা-বাবা ছিলেন অত্যন্ত ভীরু এবং সহজ সরল মানুষ। তারা
মহাদেবীকে অনুরােধ করলেন কৌশিককে বিয়ে করতে। কিন্তু কৌশিক
ছিলেন ভবী সম্প্রদায়ভুক্ত অর্থাৎ যাঁরা শৈব নন তাদের অন্তর্গত। তাই
মহাদেবী অবজ্ঞার সঙ্গে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন।
ছােটবেলা থেকেই মহাদেবী ছিলেন চেন্না মল্লিকার্জুনের ভক্ত। কোনাে
নশ্বর পুরুষকে বিবাহ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার মনে ছিল না। তিনি
একটির পর একটি শ্লোকের মাধ্যমে তার সে সময়কার মনােভাবের কথা
বলেছেন। তিনি বলেছেন—মাগাে আমি তারই অনুরাগিণী হয়েছি। যে
চিরসুন্দর, যার মৃত্যু নেই, যার ধ্বংস নেই, আকারও নেই।
তিনি আরও বলেছেন, চেন্না মল্লিকার্জুনই সেই সুন্দর আমার স্বামী।
আগুনে সঁপে দাও সেইসব অন্য স্বামীদের, যারা মৃত্যু ও ধ্বংসের অধীন।
হরিহরের বার্তাবাহকরা ফিরে এসে তাদের ব্যর্থতার কথা জানালেন।
তারা পরিষ্কার বলেছিলেন যে, পার্থিব ধন সম্পত্তির প্রতি মহাদেবীর বিন্দুমাত্র আকর্ষণ নেই। তিনি ভবী সম্প্রদায়ের কাউকে বিয়ে করতে
রাজী নন।
এবার কৌশিক আরও অস্থির হয়ে উঠলেন। তিনি পরিষ্কারভাবে
তার মন্ত্রীদের বলেছিলেন, অনুরােধ করে হােক বা বলপ্রয়ােগ করে হােক,
যেমন করে সম্ভব তাকে এখানে আনতেই হবে।
মন্ত্রীরা আবার গেলেন মহাদেবীর পিতার সঙ্গে দেখা করতে। রাজার
আদেশ অনুসারে পিতা যদি কৌশিকের সঙ্গে কন্যার বিয়ে দিতে রাজী না
হন, তাহলে তাদের বধ করা হবে—এমন কথাও বললেন।
এই কথা শুনে আতঙ্কে মহাদেবীর পিতামাতা মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
তারা কন্যাকে করজোড়ে প্রার্থনা করে বললেন—“মাগাে, তােমার
অভদ্রতার জন্যই আমাদের প্রাণ যেতে বসেছে। তােমার ভক্তি দেখছি
বড়াে অদ্ভুত জিনিস। শৈবনারীরা কি কখনও কোনাে ভবী সম্প্রদায়ে
বিয়ে করেনি? তাহলে তুমি কেন এমন আচরণ করে আমাদের মৃত্যুর
দিকে ঠেলে দিচ্ছ? কৌশিককে স্বামী হিসেবে বরণ করাে, দেখবে জীবন
সুখের হবে।
মহাদেবীর কাছে এটা ছিল একটা প্রচণ্ড আঘাত। মা বাবার জীবন
রক্ষার কথা তাকে ভাবতে হল। শেষ পর্যন্ত সাধুদের একটি বাণী তার
মনে এল—যে কোনাে উপায়ে শিবভক্তদের রক্ষা করা উচিত। স্বজনদের
রক্ষার করার জন্য সবরকম দুঃখ যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে।
তিনি আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত হলেন। পিতামাতাকে শান্ত করে
মন্ত্রীদের জানালেন, এ বিয়ের প্রস্তাবে তিনি রাজী আছেন। কিন্তু তার
কতকগুলি শর্ত আছে। তিনি নিজের ইচ্ছে মতাে শিব আরাধনায়
আত্মনিয়ােগ করবেন। তিনি মহেশ্বর এর ভক্তবৃন্দের সঙ্গে ইচ্ছে মতাে
সময় কাটাবেন। এই শর্ত যদি তিনবারের বেশি লঙ্ঘন হয় তাহলে এই
বিয়ে ভেঙে যাবে। মন্ত্রীরা সানন্দে এইসব শর্তে রাজী হলেন। একটি চুক্তিপত্র রচনা করা
হল। মহাদেবী বিয়ে করতে সম্মত হয়েছেন শুনে কৌশিক আনন্দে আত্মহারা
হলেন। কন্যার পিতাকে প্রচুর অর্থ সম্পদ দান করা হল।
দেখতে দেখতে শুভ বিয়ের দিন এসে পড়ল। মহাদেবী অলংকার
সজ্জায় সজ্জিত হলেন। তবে তাঁর অন্তর ছিল হতাশায় পরিপূর্ণ। স্বামী
গৃহে গিয়ে স্বাধীনভাবে শিব আরাধনা করতে পারবেন কিনা, এই প্রশ্ন
তাঁর মনকে আলােড়িত করেছিল।
কৌশিকের বিবাহিতা স্ত্রী হিসেবে তারই প্রাসাদে বসবাস করতে
থাকলেন আক্কা মহাদেবী। স্বামী কিন্তু স্ত্রীর ধর্মাচারণে কোনাে বাধা দেননি।
যতক্ষণ ইচ্ছে তিনি শিবের আরাধনা করতে পারতেন। শিবলিঙ্গকে হাতে
নিয়ে ব্যাকুলভাবে তার দিকে চেয়ে থাকতেন। চেন্না মল্লিকার্জুনের গুণগান
করতেন। একজন ভবী অর্থাৎ শিবের প্রতি যার বিন্দুমাত্র ভক্তি নেই,
তেমন পুরুষের স্ত্রী হওয়ার বন্ধন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা করতেন। সামান্য
আহার করতেন। নিত্যনতুন বচন লিখে ভক্তদের হৃদয় আনন্দে প্লাবিত
করতেন। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে তার অন্তর অন্ধকার ছেয়ে আসত। কৌশিক
তাকে ডেকে পাঠাতেন। ভক্তদের বিদায় দিয়ে শিবের জন্য আরও একটি
গান রচনা করে তিনি মলিন বস্ত্র ধারণ করতেন। অসজ্জিত অবস্থায়
কৌশিকের শয়নকক্ষে প্রবেশ করতেন।
কৌশিক কিন্তু প্রাণ দিয়ে মহাদেবীকে ভালােবেসে ছিলেন। মহাদেবীর
এই উদাসীনতাও তার কাছে পরম গ্রহণীয় বলে মনে হত। মনে হত যেন
পরশপাথরের প্রতিমা একটি লােহার মূর্তিকে স্পর্শ করেছে। আর তার
ফলে লােহার মূর্তিতে সােনার রং ধরেছে।
এইভাবেই দিন কাটতে থাকে। একদিন কয়েকজন মহেশ্বর দূর দেশ
থেকে রাজপ্রাসাদে এসেছেন। মহাদেবী তখন বিশ্রাম গ্রহণ করছিলেন।
কৌশিক ভক্তদের বাধা দেবার চেষ্টা করলেন। মহাদেবীর ঘুম ভেঙে গেল। কৌশিক ভক্তদের প্রতি দুর্ব্যবহার করেছেন শুনে তিনি কান্নায়
ভেঙে পড়লেন। বিবাহের শর্ত অনুসারে এটি ছিল প্রথম অপরাধ। অনেক
সাধ্য সাধনার পর মহাদেবী এই অপরাধ ক্ষমা করেছিলেন।
এবার এল দ্বিতীয় অপরাধ। একদিন সকালে শুদ্ধাচারে বসে মহাদেবী
পূজায় মগ্ন ছিলেন। কৌশিক গােপনে তাকে দেখলেন। দেখতে দেখতে
তিনি মহাদেবীর সৌন্দর্যে বিভাের হলেন। পূজার্চনারত মহাদেবীকে বুকে
জড়িয়ে ধরলেন, পূজায় বাধা পড়ল। মহাদেবী কৌশিকের মুখ দেখে
ক্রোধে বােধশূন্য হলেন। রাগে দুঃখে কটু বাক্য প্রয়ােগ করলেন। একজন
ভবী হওয়া সত্ত্বেও কৌশিক কিভাবে মহাদেবীকে স্পর্শ করলেন, এই হল
দ্বিতীয় অপরাধ।
এবার তৃতীয় অপরাধও এসে গেল। এবার মহাদেবী স্বামীর সঙ্গে
নির্জনে ছিলেন। এই সময় তার গুরু রাজপ্রসাদে এসে উপস্থিত হন। তখন
তাঁর অঙ্গে উপযুক্ত সাজসজ্জা ছিল না। সেই অবস্থাতেই তিনি গুরুকে
প্রণাম করার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠলেন। স্ত্রীর এহেন আচরণ দেখে কৌশিক
খুবই অপমানিত বােধ করলেন। মহাদেবীর শরীরে সামান্য যেটুকু অঙ্গবাস
ছিল, তিনি তা টেনে খুলে ফেললেন। বললেন—“তােমার মতাে এত
বড়াে সন্ন্যাসিনী কেন কাপড় দিয়ে শরীর ঢাকবে?”
এইভাবে তিনটি অপরাধ সম্পূর্ণ হল। কৌশিক তিনবার বিয়ের শর্ত
লঙ্ঘন করলেন।
যে মুক্তি মহাদেবী প্রার্থনা করছিলেন, এবার সেই মুক্তি তার আয়ত্তের
মধ্যে এসে গেল। শিবলিঙ্গকে নিয়ে তিনি কৌশিকের রাজপ্রাসাদ ত্যাগ
করলেন। নতুন মুক্তির উল্লাসে তার মন তখন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
তিনি চেন্না মল্লিকার্জুনের আবাস স্থল শ্রীশৈল পর্বতের দিকে এগিয়ে
চললেন। শেষ পর্যন্ত তীর্থযাত্রার শেষ লক্ষ্যে পৌঁছলেন। বাধাহীনভাবে
শিব আরাধনায় মগ্ন হলেন। তখনও পূর্ব জীবনের ছায়া তাকে অনুসরণ করছে। পিতামাতা কন্যার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তরুণী কন্যাকে এই
বেশে দেখে তাদের অন্তর দুঃখে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। মহাদেবী অবশ্য মা
বাবার অনুরােধে কান দিলেন না। তিনি বললেন- ‘এতদিনে আমি
কৌশিকের কাছ থেকে মুক্তি পেয়েছি, শিবের সেবায় নিজেকে নিযুক্ত
করতে পেরেছি।
তার বিশ্বাসের দৃঢ়তায় মা-বাবা অবাক হয়ে গেলেন। তাকে কিছু না
বলে স্থান ত্যাগ করলেন। এবার কৌশিক নতুন রূপ ধরে উপস্থিত হলেন।
কৌশিকের ধারণা হয়েছিল, যদি তিনি শৈব সাজেন, তাহলে মহাদেবীর
প্রেম ফিরে পেতে পারেন। রুদ্রাক্ষের মালা ধারণ করে সারা দেহে ভস্ম
মেখে মহাদেবীর পায়ের ওপর আছড়ে পড়লেন। বললেন—তিনি এখন
শিবভক্ত হয়েছেন, মহাদেবী যেন তাঁকে করুণা করেন।
মহাদেবীর জীবনীকার হরিহর এই সময়কার কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি
বলেছেন –এই অপ্রত্যাশিত ঘটনা প্রত্যক্ষ করে মহাদেবী একটি সুপরিচিত
বচন লিখেছিলেন। এই বচনটি হল এইরকম—হে প্রভু, তােমার মায়া তাে
আমাকে ছাড়ে না। অথচ আমি তাকে ছেড়ে এসেছি। আমি বারবার বাধা
দেবার চেষ্টা করছি, তবুও সে নিঃশব্দে আমাকে অনুসরণ করছে।
তােমার মায়া যােগীর কাছে যােগিনী হয়, সন্ন্যাসীর কাছে সন্ন্যাসী
আর সাধুর সন্ন্যাসিনীর কাছে অনুচর। প্রত্যেকের স্বভাব অনুসারে সে
নিজেকে নিত্য নতুনভাবে সাজায়।
আমি যখন পাহাড়ে উঠলাম, তােমার মায়াও আমার সঙ্গে এল।
আমি যখন অরণ্যের নিভৃতে প্রবেশ করলাম, তােমার মায়া আমাকে
অনুসরণ করল। দেখাে, আমি সংসার ত্যাগ করে চলে এসেছি। তবু মায়া
আমাকে পিছনে টানছে।
হে অপার করুণাময় প্রভু, তােমার মায়া আমাকে ভীত সন্ত্রস্ত করে
তুলেছে। হে প্রভু মল্লিকার্জুন, তুমি আমাকে আশীর্বাদ করাে। তখন সত্যি সত্যি মহাদেবী মায়াকে পরাস্ত করেছিলেন। তিনি
কৌশিকের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি কয়েকজন শৈব ভক্তের
শরণাপন্ন হলেন। মহেশ্বররা মহাদেবীকে ডেকে পাঠালেন। মহাদেবী
তখন গভীর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। কাজেই তিনি এই ডাকে সাড়া দিতে
পারলেন না।
কিছুদিন বাদে মহাদেবী তার নশ্বর অস্তিত্বের জন্য ক্লান্তি বােধ করলেন।
তিনি শিবের কাছে প্রার্থনা করলেন যেন, শরীরের বন্ধন থেকে যেন
তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। শিব তার প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। দিব্য
শরীরে তিনি কৈলাসে চলে গেলেন।
মহাদেবীর অসংখ্য রচনার মধ্যে আধ্যাত্মিক উপদেশ আছে। আছে
জীবনকে সৎ, সুন্দর এবং শােভন করার নানা পরিকল্পনা।
ঈশ্বরের দয়িতা মহাদেবী তার প্রেমের অধীশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
তিনি কন্নড় ভাষায় যেসব বচন লিখেছিলেন, তা অও কন্নড় সাহিত্যের
অন্যতম সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়।
তিনি লিখেছিলেন—এসাে, এসাে গাে আমার দয়িত, তুমি চন্দন
সুবাসিত স্বর্ণশােভিত, দিব্য বস্ত্র পরিহিত, তােমার আগমনে আমি আমার
এ দেহে প্রাণ ফিরে পাব।
আমি পথের দিকে চেয়ে আছি। আর তৃষ্ণায় কণ্ঠ পুড়ে যায়। আশা
শুধু চেন্না মল্লিকার্জুন আবার আসবে।
বিশ্বের সর্বত্র ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করে মহাদেবী
লিখেছিলেন—তুমি অরণ্য, অরণ্যের বনস্পতিও তুমি, বনস্পতির ফাকে
ফাকে যত পশুপাখি ঘুরে বেড়ায়, তারাও তুমি, হে চেন্না মল্লিকার্জুন,
তােমার মুখের আবরণ উন্মােচিত করাে, সর্বভূতে দেখা দাও তুমি।
ঈশ্বরের রূপ প্রত্যক্ষ করে মহাদেবী বলেছেন—আমি তাকে দেখেছি
তাঁর দিব্য বেশে, সেই জটাজুটধারী দেহ, দিব্যরত্নশােভিত, অধরে হাসি, সদা হাস্যময় তাকে দেখেছি, চতুর্দশ ভুবন আলােকিত করা তার রূপ
আমি দেখছি।
দু’চোখে তৃষ্ণা আমার তীব্র হয়েছে। শেষপর্যন্ত আমি পরমেশ্বরকে
দেখেছি, যাঁকে পুরুষরাও পত্নীর মতাে সেবা করে। আমি দেখেছি সেই
পরম গুরু চেন্না মল্লিকার্জুনকে—আদি জননী শক্তির সঙ্গে লীলারত অবস্থায়
আর আমি ধন্য হয়ে গেছি।
এইভাবেই তিনি মূর্তিময় ঈশ্বরের অস্তিত্ব উপলব্ধিকে আত্মস্থ করেছেন।
শেষপর্যন্ত মহাদেবী আরও ঊর্ধ্বে উঠেছিলেন। মূর্তিহীন আদিরূপের সঙ্গে
অতীন্দ্রিয় মিলনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। একটি বচনের মাধ্যমে
তিনি তার মনের ভাব বর্ণনা করেছেন। তিনি অজ্ঞেয়কে জ্ঞানের সীমার
মধ্যে প্রকাশ করেছেন এইভাবে—আমি বলি না এটা লিঙ্গ, এটা বলি না
এটা লিঙ্গের সঙ্গে একাত্মতা, আমি বলি না এটা মিলন, অথবা সংগতি,
আমি বলি এটা সঙ্গচ্যুত এবং অসঙ্গচ্যুত। চেন্না মল্লিকার্জুনের লিঙ্গ শরীরে
এক হয়ে যাওয়ার পর আমি আর কিছুই উপলব্ধি করতে পারি না এখন।
এই উক্তি মাধ্যমে বিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতার এক চরম দর্শনকে
প্রকাশ করা হয়েছে।
Power by: © YogiKathaOfficial