Type Here to Get Search Results !

   Choose Your Language   

আচার্য রামানন্দ স্বামীর রহস্যময় জীবন । Acharya Ramanand Biography in Bengali, Indian famous Hindu monk,

 আচার্য রামানন্দ



জাতি পাতি পছই নাহি কোই

হরিকো ভজই সে হরিকো হােই।


অর্থাৎ জাত-পাতের প্রশ্ন করাে না। পৃথিবীর সব মানুষ এক ও

অভিন্ন। সারাজীবন শুধু হরির চরণ সেবা করাে। হরিকে যে ভজন করবে

সেই হরির আপনজন হয়ে উঠবে।

এই ছিল আচার্য রামানন্দ প্রচলিত ধর্মমতের মূল কথা। এই হরির

স্বরূপ কী? আসলে তিনি কে? তিনি কি রামায়ণের শ্রীরামচন্দ্র ? তাই তার

সম্প্রদায়ের নামকরণ করা হয়েছে রামাওয়াত সম্প্রদায়। আচার্য রামানন্দ

রামমন্ত্র আর রামভজনের কথা বলেছেন। একসময় তিনি এই বিষয়টিকে

এক গণ আন্দোলনের রূপ দিয়েছিলেন। উত্তর ভারতের জনজীবনে তার

প্রভাব ছিল অপ্রতিরােধ্য।

তিনি সংস্কারপন্থী মহাপুরুষ হিসাবেই পৃথিবীতে আবির্ভূত

হয়েছিলেন। তাই রুইদাস এবং কবীরকেও রামনামে দীক্ষা দিতে ভুল

করেননি। তখন ভারতে তুঘলক বংশের রাজত্বকাল। দিল্লিতে চলেছে

সুলতানি আমল। সমাজ এবং ধার্মিক অনুশাসন কঠিন থেকে কঠিনতর

হচ্ছে। রামানন্দ এই সময় ভারতে আবির্ভূত হলেন। হয়তাে যুগের

প্রয়ােজনেই তিনি এসেছিলেন। তিনি সহজ সরল ভাষায় অধ্যাত্ম সাধনার

কথা বললেন। তার ডাকে সাড়া দিয়ে ব্রাহ্মণদের পাশাপাশি অব্রাহ্মণরাও

এলেন। তারা সকলেই গুরু রামানন্দকে আচার্য হিসাবে বরণ করে

নিয়েছিলেন। রামানন্দ তাঁর বাণী প্রচার করেছিলেন সহজ সরল কথ্য হিন্দি ভাষার

মাধ্যমে। তার ভক্ত শিষ্যরাও হিন্দি ভাষার মাধ্যমে একাধিক পদ্য লিখতে

থাকেন। তাঁর শিষ্য শুকানন্দ এবং উত্তর সাধক কবীরের দোঁহা হিন্দি

ভাষাতে রচিত হয়েছিল। রামানন্দ এবং তার অনুগামীদের রচনাশৈলীতে

হিন্দি ভাষা আরও ঐতিহ্যশালী হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়,

হিন্দি সাহিত্যের অমর ভক্ত কবি তুলসীদাসও ছিলেন রামাওয়াতন্থী।

আচার্য রামানন্দের জন্ম হয়েছিল ১২৯৯ খ্রিস্টাব্দে। তিনি জন্মে ছিলেন

প্রয়াগের কাছে মালকোট জনপদে। তার পূর্বাশ্রমের নাম রামদত্ত, পিতা

পূণ্যসদন, তিনি ছিলেন এক সুপণ্ডিত ব্রাহ্মণ। মায়ের নাম সুশীলাদেবী।

একসময় মালকোট শৈব ব্রাহ্মণদের একটি প্রসিদ্ধ কেন্দ্র ছিল। আচার্য

রামানুজ পরিব্রাজন করতে করতে এখানে কিছুকাল অবস্থান করেছিলেন।

তিনি স্থানীয় ব্রাহ্মণদের স্বমতে নিয়ে আসেন। ইস্টদেব শ্রীবিষ্ণুদেবের

বিগ্রহ স্থাপন করে শ্রীরঙ্গমে ফিরে যান। রামানুজের স্মৃতি বিজড়িত এই

স্থানটি আচার্য রামানন্দের জন্মভূমি হিসাবে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছে।

আট বছর বয়সে তাঁর উপনয়ন সংস্কার শেষ হয়। এরপর শুরু হয়

কঠিন অধ্যবসায়ের মাধ্যমে শাস্ত্র অধ্যয়ন। তখনকার দিনে গুরুগৃহে থেকে

অনেক কষ্ট করে পড়াশােনা করতে হত। রামানন্দকেও সেই পন্থা অনুসরণ

করতে হয়েছিল। পড়াশােনার প্রতি ছিল তার সহজাত আকর্ষণ। অত্যন্ত

মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি।

শাস্ত্রের উচ্চতর পাঠ শিক্ষার জন্য পিতা তাঁকে বারাণসী ধামে

পাঠালেন। বারাণসী ছিল সংস্কৃতিচর্চার শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র। বেদ-বেদান্ত প্রভৃতির

আলােচনা হত সেখানে। সেখানে গিয়ে রামানন্দ স্মার্ত আচার্যের

চতুষ্পঠীতে ভর্তি হলেন। এখানেই একদিন নাটকীয়ভাবে রাঘবানন্দজীর

সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। তখন তিনি কিশাের রামদত্ত।

প্রথমে দর্শনেই রামানুজ সম্প্রদায়ের আচার্য রাঘবানন্দজী বুঝতে

পেরেছিলেন এই কিশােরের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা লুকিয়ে আছে। রাঘবানন্দজীকে আমরা বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের অন্যতম ব্যাখ্যাকার বলে থাকি।

তিনি অলৌকিক শক্তির অধিকারী। তিনি যােগ বলে বিভূতি আনতে

পারতেন। তার চোখে রামদত্ত অন্যভাবে প্রতিভাত হলেন। তিনি চতুষ্পঠির

পণ্ডিতদের কাছে আবেদন করে রামদত্তকে সেখান থেকে নিজের আশ্রমে

নিয়ে রামদত্তের গুরু হলেন। শিষ্যের নামকরণ করা হল রামানন্দ।

অসামান্য প্রতিভাধর মেধাবী ছাত্র রামানন্দ সর্বশাস্ত্রে প্রভূত পাণ্ডিত্য

অর্জন করেছিলেন। রাঘবানন্দের ইচ্ছে ছিল রামানন্দ যেন উত্তর ভারতের

শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব আচার্য হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। তিনি

যেন উত্তর ভারতের জনজীবনে রামানুজীয় তত্ত্ব প্রচার করতে পারেন।

কাশীতে জনশ্রুতি আছে, এইসময় রামানন্দের পরমায়ু শেষ হয়ে

আসছিল। জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে রামানন্দের যৌবনে মৃত্যুলগ্ন ছিল। গুরু

রাঘবানন্দ ছিলেন ত্রিকালজ্ঞ মহাপুরুষ। তিনিও জানতেন এইভাবে

অকালে রামানন্দকে চলে যেতে হবে। কিন্তু তা হলে কে এই বিরাট

দায়িত্ব সম্পন্ন করবেন ?

তিনি অলৌকিক যােগশক্তির বলে রামানন্দের পরমায়ু বাড়িয়ে

দিয়েছিলেন। গুরুর কৃপায় রামানন্দ একশাে বছরের বেশি জীবিত ছিলেন।

একদিন গুরু রামানন্দকে ডেকে বললেন—বৎস, তােমার শাস্ত্র অধ্যয়ন

শেষ হয়েছে। তুমি অনেক সাধন ভজন করেছ। কিন্তু এইভাবে নিশ্চিন্তে

আরামের পরিমণ্ডলে থাকলে তাে সিদ্ধিলাভ হবে না। তুমি এবার প্রব্রজ্যা

গ্রহণ করাে।

গুরুর আদেশে রামানন্দ পরিভ্রমণের পথে বের হলেন। কাশ্মীর থেকে

কন্যাকুমারিকা আর গুজরাট থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত বিশাল ভারতের

নানা অঞ্চলে গেলেন। এই সময় তিনি গঙ্গাসাগরে কপিল মুনির সাধনাস্থল

মানসচক্ষে দেখেছিলেন। স্থানীয় জনসাধারণের প্রয়াসে কপিল মুনির আশ্রম

প্রতিষ্ঠিত হল।

ভারতের পথে প্রান্তরে ঘুরতে ঘুরতে নানা জাতের মানুষের সঙ্গে তাঁর সখ্যতার সম্পর্ক হয়েছিল। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাধু

সন্ন্যাসীদের কাছেও এসেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এখন ভারতীয়

সমাজে নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। হিন্দুধর্ম আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্ব

হয়ে উঠেছে। মুসলমান শাসক সম্প্রদায় দলিত শ্রেণীর হিন্দুকে আকৃষ্ট

করছেন। লক্ষ লক্ষ হিন্দু অন্য ধর্মমত গ্রহণ করছে। তিনি বুঝতে পারলেন

অবিলম্বে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।

তার নেতৃত্বে রামাওয়াত সম্প্রদায় তৈরি হল। একে অনেকে রামনন্দী

সম্প্রদায়ও বলতেন। গুরু রাঘবানন্দ শিষ্যের উদার ভাবধারাকে মনে

প্রাণে মেনে নিয়েছিলেন। অনেকে রামানন্দের এই সহজ সরল সাধনপন্থর

সমালােচনা করলেন। তারা ভাবলেন, এই ভাবে ধর্ম আন্দোলন গড়ে

তােলা যায় না। এই আন্দোলনের তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তা আছে,

কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন জনমানসে স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করতে

পারবে না।

তবে সন্ন্যাসী রামানন্দ তার পথ থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি সর্বত্র

রামমন্ত্র প্রচার করলেন। রামনাম জপ করলে আমরা যে কোনাে অন্যায়ের

হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারব—এমন এক বিশ্বাসের জন্ম হল

মানুষের মনের মধ্যে। রামচিন্তন আর রামভজনের মাধ্যমে আচার্য

রামানন্দরামসীতার শুচি সিদ্ধ আরাধনার প্রবর্তন করলেন। অল্পসময়ের

মধ্যে তিনি সমগ্র উত্তর ভারতে এক ধার্মিক নবজাগরণের সৃষ্টি

করেছিলেন।

সুদীর্ঘকাল জীবিত থেকে আচার্য রামানন্দ পরম নিষ্ঠা সহকারে ধর্ম

প্রচার করতে থাকেন। তার ধর্মমতের ওপর নির্ভর করে চার শ্রেণীর

নাগা সাধুর আবির্ভাব ঘটে গিয়েছিল। উত্তর ভারতের ধর্মীয় এবং সামাজিক

আন্দোলনে এইসব নাগা সাধুদের অবদানের কথা আমরা কখনাে ভুলতে

পারব না।

মহাবৈষ্ণব সিদ্ধসাধক আচার্য রামানন্দ স্বামী ১৪১০ খ্রিস্টাব্দে ১১১

বছর বয়সে কাশীধামে পরলােক গমন করেন।

Power by: © YogiKathaOfficial

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.