Type Here to Get Search Results !

   Choose Your Language   

যোগীগুরু কিভাবে লাভ হয়,যোগাভ্যাস কি?,How is Yogiguru profitable?,What is Yoga?,

 যোগীগুরু লাভ ও যোগাভ্যাসঃ--

....................

Yoga




মিশমী পাহাড়ী অন্চলের বর্ষাকাল। একটা ছেড়া ছাতা যোগাড় করে নিগমানন্দ সে অন্চলের পার্বত্য শোভা দেখতে বেড়িয়ে পড়লেন এক অপরাহ্নে। সন্ধা ঘনিয়ে এল। তাঁর মনে হল, ঘন অরন্যে তিনি পথ হাড়িয়ে ফেলেছেন। বিপদ যে কতখানি তা বুঝতে পেরেই কাছাকাছি একটা গাছের কোটরে রাত কাটাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। ভাঙ্গা ছাতাটি খুলে কোটরের মুখটা বন্ধ করে দিলেন। ভোর হতে না হতেই দেখলেন- গাছের তলায় শুকনো পাতায় আগুন জ্বালিয়ে কে যেন বসে আছেন। সাহসে ভর করে নামলেন। দেখলেন একসাধু গাঁজার কলকে টানছেন। হঠাৎ সব গুটিয়ে নিয়ে সাধু নিগমানন্দকে ইঙ্গিতে তাকে অনুসরন করতে বললেন।


নিগমানন্দ খুব ভয় পেলেন। তবুও কিসের টানে যেন সাধুর পিছু পিছু দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করে গেলেন। অবশেষে তারা পৌছেলেন এক প্রসস্ত উপত্যকায়। সন্ন্যাসী পাহাড়ের গা থেকে কৌশলে এক বৃহদাকার প্রস্তর খন্ড সরিয়ে দিলেন। ভিতরে গিয়ে দেখেন সুন্দর সুপরিসর গহ্বর। সন্ন্যাসী এতক্ষনে কথা বললেন- আমি তোমাকে আনার জন্যই ভোর রাতে ওখানে গিয়েছিলাম। তুমি নিশ্চয় খুব আশ্চর্য হয়েছ। আমি সুমেরদাস, তোমার নিদ্দিষ্ট যোগীগুরু।


সুসেরদাসজী নিগমানন্দের জীবনের ভুত-ভবিষ্যৎ সব জানতেন। তার বিপুল যোগবৈভবের পরিচয় পেয়ে তার চরণে প্রনত হলেন নিগমানন্দ। সুমেরদাসজী তার তরুন শিষ্যের নাম দিয়েছিলেন ‘গুরুচরণ’। পরম স্নেহে ও অকৃত্রিম যত্নে তিনি তার প্রিয় শিষ্যকে পাতঞ্জল দর্শনের অন্যান্য গুপ্ত যোগসাধনার দুর্গম সিড়িগুলি পার করিয়ে দিলেন। হস্তলিখিত পুতির সাহায্যে স্বরোদয় শাস্ত্র শেখালেন। দেহতত্ত, বায়ুতত্ত, নাড়িতত্ত প্রভৃতি যোগশাস্ত্র ও স্বরোদয় শাস্ত্রের মর্মকথা- সুমেরদাজীর নিকট সে সবের মৌখিক বিশ্লেষন বিশ্ময়কর প্রক্রিয়াগুলির চাক্ষুস প্রমাণ ও দর্শণে নিগমানন্দ অভিভুত হয়ে গেলেন। তারমত গুরু পেয়ে নিজেকে কৃতকৃত্য মনে করলেন। যোগশাস্ত্রের কূটস্থান গুলির বিশদ ব্যাখ্যা ও প্রক্রিয়া, সমাধি অধিগত হলে দেহে কী রূপ চিহ্নদি প্রকট হয়, তাও গুরু দেখিয়ে দিলেন। প্রকৃত যোগী গিরিগুহায় থাকেন, লোকারয়ে নয়। কিন্তু যোগবলে বিশ্বব্রমান্ডের সব খবরেই তার নখদর্পনে থাকে। সিদ্ধ যোগীরা লোক কল্যানের জন্যই স্থুল দেহ ধারন করে থাকেন। একদিন তার কাছ থেকে নিগমানন্দ জেনেছিলেন যে তন্ত্রসিদ্ধ ব্রক্ষ্মানন্দ গিরিই এই দেহে নিগমানন্দ।


একদিন বিকেলে সুমেরদাস শিষ্যকে নিয়ে বেড়াতে বেড়িয়েছিলেন। হঠাৎ দুজনেই স্তব্ধ হয়ে সামনে দেখেন এক বিরাটকায় ব্যঘ্র। সুমেরদাসজী বাঘটার চোখের উপর তার চোখ রেখে দাড়াতেই লম্ফোনোদ্যত বাঘটি লেজ গুটিয়ে নিল এবং বাঘের চোখ থেকে তার চোখ সরাতেই বাঘটি দ্রুত প্রস্থান করল। গুরু শিষ্যকে বুঝিয়ে দিলেন, একে ত্রাটকযোগ বলে। মানুষ যে সর্বশক্তির আধার, আর তার সেই শক্তিকে জাগাতে পারলেই মানুষ পৃথিবীকে করায়াত্ত রাখতে পারে।


সুমেরদাস একদিন নিভৃতে শিষ্যকে ডেকে বললেন- শোন গুরুচরণ, বনে, জঙ্গলে, পর্বত গুহায় এতদিন তোমাকে যা শিখালাম, এবার তার হাতে কলমে সাধনা করতে হবে। কচুসিদ্ধ আর কন্দমূল খেয়ে যোগসাধনা হবে না । এই রাজযোগ সাধনায় রাজার মত প্রচুর ঘি দুধ খেতে হবে। তাই তোমাকে লোকালয়ে যেতে হবে। কোন সাত্ত্বিক ধনী ব্যাক্তির আশ্রয়ে থেকে তোমাকে হঠযোগ, রাজযোগ ও ধীযোগের সাধনাগুলি করতে হবে। আমি তার জন্য সব ব্যাবস্থা করে রেখেছি। তুমি বেড়িয়ে পড়। 


যোগাভ্যাস


 সুমেরদাসজীর অলৌকিক যোগবিভূতির ফলে পাবনা জেলার হরিপুর গ্রামের ব্রাক্ষ্মন জমিদার রায় সারদাপ্রসাদ মজুমদার নিগমানন্দের যোগসাধনার আশ্রয়দাতা হলেন। সারদাবাবু ভোর রাতে স্বপ্ন দেখেছেন- এক পাচ হাত লম্বা সাধু তাকে বলছেন- তোদের দেবালয়ে একজন সন্ন্যাসী এসে রাত কাটাচ্ছেন, যোগসাধনার জন্য সে কোন এক ধনী ব্যক্তির সাহায্যপ্রর্থী। তুই তাকে সাহায্য কর- তোর প্রভূত মঙ্গল হবে। ঘুম ভেঙ্গে ছুটলেন দেবালয়ে। নিগমানন্দকে দেখে তার পরিচয় পেয়ে তাকে বাড়িতে নিয়ে গেলেন এবং সব রকম সাহায্যের প্রতিশ্রতি দিলেন। নিগমানন্দ তাকে সতর্ক করে দিলেন, সাধনার জন্য যে আমি এখানে এসেছি- সে কথা যেন কেউ জানতে না পারে। সারদাবাবু সে কথা মেনে নিয়ে তার প্রয়োজন মত তিন কুঠরীর একটা চালা বানিয়ে দিলেন তার বাগান বাড়িতে। একটিতে সাধক পাক করে খেতেন, একটিতে শুতেন আর অপরটিতে সাধনা করতেন। দুধ ঘি মাখন ও অন্যান্য ভোজ্যদ্রব্য চাইলেই পেতেন।


 শরীর শোধনের জন্য ধৌতি, বস্তি, নেতি, লৌকিকী, ত্রাটক, কপালভাতি- ষটকর্মের জন্য প্রথম প্রথম উদ্যান মধ্যস্থ পুস্করিনী ব্যবহার করতেন। বেশ চলছিল, কিন্তু দেখা গেল পোস্করিনীতে স্নানের অছিলায় বহু স্ত্রী পুরুষ সন্ন্যাসীর দর্শনলাভের জন্য আসতে লাগল। সাধক,- সারদা বাবুকে সে বিষয়ে জানালেন। সারদাবাবু উদ্দ্যানের মধ্যে আবৃত স্থানে লোকচক্ষুর আড়ালে একটা বড় চৌবাচ্চা তৈরী করে দিলেন। এতে বাইরের উপদ্রব কমলো বটে কিন্তু একটা নতুন উপদ্রব এল। সে ঘটনাটি প্রকাশ করা যায় না- প্রকাশ করলে তাদের বাড়ির একজনের প্রাণ সংশয়ের সম্ভাবনা। তাই সাধক বাধ্য হয়ে সারদা বাবুকে কিছু না বলে শুধুমাত্র একটুকরো কাগজে লিখে রেখে গেলেন- সাধন কার্যে নানা রূপ অসুবিধার জন্য ও অন্যকোন এক গুরুতর কারনে এস্থান ছেড়ে গুরুর আদেশে অন্যত্র চললাম।


সাধক হরিপুর ত্যাগ করলেন এবং সিরাজগন্জ হয়ে হরিপুর পৌছলেন। কোন আশ্রয় ঠিক করতে না পেরে কামাক্ষা যাবার মনস্থ করলেন। একদিন সকালে পথে যেতে যেতে এক বাড়ি থেকে একজনের ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে ডাক শুনলেন- ওহে সন্ন্যাসী ঠাকুর শোন শোন কোথায় যাওয়া হচ্ছে? নিগমানন্দ ধির কন্ঠে বললেন, কামাক্ষা দর্শনে যাবার ইচ্ছে। ভদ্রলোক বললেন- কামাক্ষা দর্শনে না হয় কাল যেও, আজ এখানে থেকে যাওনা কেন? সন্ন্যাসী বিশেষ আপত্তি করলেন না। ভদ্ররোক তখন তার বাড়িতে একটি কুঠরিতে সন্ন্যাসীর থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। নিগমানন্দ স্নানাদি সেরে আসন করে গীতা পাঠ শুরু করলেন। ভদ্রলোক গৌহাটির অতিরিক্ত সহকারী কমিশনার নাম যজ্ঞেশ্বর বিশ্বাস। অফিসে বেরোবার আগে সাধুর ব্যবস্থাদি ঠিক হয়েছে কি-না দেখতে এলেন। সাধুকে গীতাপাঠ করতে দেখে বললেন- কি গীতাপাঠ করো নাকি? কি রূপে গীতাপাঠ কর? গুরুর উপদেশ অনুযায়ী না নিজে নিজে? নিগমানন্দ বললেন, না, গুরু বুঝিয়ে দিয়েছেন।


বাবু বললেন আচ্ছা বলো দেখি- জাতস্য হি ধ্রবো মৃত্যু র্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ। এর অর্থ কী? জন্মালে যদি মরতেই হয় আর মরলেই যদি জন্ম হয়, তবে এত পড়াশুনা করে কী লাভ।  


নিগমানন্দ বোঝার চেষ্টা করলেনঃ জন্মের পর মৃত্যু আর মৃত্যুর পর আবার জন্ম, এই তো বিধির বিধান। এটাই আমরা স্থুল ভাবে জানি কিন্তু যদি সদগুরুর চরণাশ্রয় নিয়ে যদি তার প্রদর্শিত সাধন পন্থায় আত্মসাক্ষাৎকার করা যায়, তবেই প্রত্যক্ষ জ্ঞানলাভ হয় যে দেহীর জন্ম মৃত্যু নাই। দেহ জড় বস্তু, জড়ের উপর অভিমান আমিত্ববোধ চলে গেলে জড়ের আর আগমন হয় না।


বাবু খুশি হয়ে বললেন- এ তো খুব সুন্দর মীমাংসা। এখন কাছারির বেলা হয়ে গেছে। সন্ধায় ফিরে এসে আবারও আলোচনা করা যাবে।


সন্ধায় আরও গীতাচর্চা হলো। পরস্পরের পরিচয় হল। নিগমানন্দের সব কথা শুনে তিনি তাকে সাহায্য করতে চাইলেন। তারা সংসারে স্বামী স্ত্রী দু জন।ছেলেপুলে নাই। স্ত্রীর নাম মৃণালিনী দেবী অপর নাম সরযু দেবী। যজ্ঞেশ্বর বিশ্বাসের নিবাস রাজশাহী জেলা। গৌহাটিতে ভাড়া বাড়িতে থাকেন। তার সংঙ্গে কথাবলে নিগমানন্দ খুব শান্তি পেলেন। যজ্ঞেশ্বর বাবুও সাধকের সব সাধনার কথা গোপন রাখতে ও তার জন্য সব ব্যায়ভার গ্রহন করতে রাজি হলেন। 


নিগমানন্দ তার দরকারী জিনিষপত্র যোগাড় করে নিলেন। হরিপুরে প্রায় একবছরে ষাটকর্ম সাধন হয়ে গিয়েছিল। যম, চিত্তশুদ্ধি হয়েই গিয়েছিল। নিয়ম, আসনের ধাপগুলি অতিক্রম করে ফেলেছেন। প্রত্যাহার-ধারনা-ধ্যানে স্থির হয়ে এখন তিনি প্রণায়ম অভ্যাস করতে লাগলেন। প্রানায়ম দৃঢ় হবার পর সমাধি অভ্যাস। দু চারঘন্টা ধরে রোজ কুম্ভক করে সমাধি অভ্যাস যখন খুব সহজ হয়ে গেল, তখন একদিন সবিকল্প সমাধিতে বসার সংকল্প করলেন। মৃণালিনী দেবীকে ডেকে সব বুঝিয়ে দিলেন- সমাধি হলে কি অবস্থা হয়, সমাধি ভাঙ্গতে হলে কি উপায়ে ভাঙ্গতে হবে ইত্যাদি। প্রথমে শ্বাসপ্রশ্বাস আনবার ক্রিয়া, পরে জিহ্বাতে মাখন মাখতে হবে কারন জিহ্ববা খিচরী মুদ্রা করে উপরে উঠিয়ে দেওয়া হয়, তাই নিরস হয়ে জিহ্ববা কঠিন হয়ে যায়। কাজেই তখন সরস করবার জন্যে মাখন দিয়ে দোহন করবে। তারপর তুলোর সলতে করে দুধ পান করালে চৈতন্য হবে। নিগমানন্দ তাকে সমাধি ভাঙ্গাবার কৌশলগুলি ভালভাবে বুঝিয়ে দিলেন।


নিগমানন্দ পরদিন সকালে স্বপাক খাদ্য গ্রহণ করে চব্বিশ ঘন্টার জন্য সমাধিতে বসলেন। তিনি ঐ দিন সমাধিতে একেবারে ষটচক্র ভেদ করে জীবাত্মাকে সহস্রারে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু পরমআত্মার লয় হল না।কারন সবিকল্প সমাধিতে ফেরার বাসনা থাকায় সূত্রের টান থাকে।সফল হলেন। যজ্ঞেশ্বর-মৃনালিনী দুজনের চেষ্টায় সমাধি ভাঙ্গল। পাঁচ ছয় দিন দুর্বলতা ছিল। চব্বিশ ঘন্টার সমাধি সহজ হয়ে গেলে একদিন সমাধিতে বসলেন তিন দিনের জন্য। সেবারও সফল হয়ে ফিরে এলেন। তবে দশদিন পর্যুন্ত দুর্বল ছিলেন। এভাবে তিন দিনের সমাধি অভ্যাসের পর তিনি সাত দিনের জন্য সমাধিতে বসলেন। এবার যজ্ঞেশ্বর-মৃণালিনী সমাধি ভাঙ্গতে পারেন নি। ঘাবড়ে গিয়ে ডাক্তার ডেকেছিলেন। ডাক্তররা সব দেখে অবাক। তখন তারই নিগমানন্দ প্রদর্শিত উপায়ে দির্ঘ প্রচেষ্টার পর সমাধি ভাঙ্গিয়েছিলেন। ষোলদিন পযুন্ত দুর্বল ছিলেন। এইভাবে সবিকল্প সমাধি সহজ হয়ে গেলে তিনি যেখানেই বসতেন সেখানেই সমাধিস্ত হয়ে পড়তেন। লোকজনের যাতায়ত শুরু হল। লোক সঙ্গ এড়াতে মাঝে মাঝে কামাক্ষা পাহাড়ে চলে যেতেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.