"দীক্ষা" নেওয়া কেন জরুরী?
![]() |
Joy Guru Maharaja |
"দীক্ষা" নেওয়ার কথা বললে অনেকেই এখন "সদ্গুরু" খোঁজেন। আসলে তারা নিজেরা সৎ শিষ্য কি না তা জানে না। তারা কখনও সাধুগুরুর সঙ্গ করে কি? তার কি যোগ্যতা আছে একজন গুরুদেবের যোগ্যতা নির্ণয় করার? অনেক কথাই বলা যেতে পারে, বেশী কথা বাড়ালাম না। এবার আসি সাধুগুরু সঙ্গ বিষয়ে। গল্পটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন ও জেনে নিন, সাধুগুরুসঙ্গ কেন প্রয়োজনীয় কেন।
এক জঙ্গলে এক সাধু নিজ সাধনকুটীরে একাহারী হয়ে ইষ্ট শ্রীকৃষ্ণের নামজপ করেই বাস করতেন। তার নামমাত্র কয়েকজন শিষ্যদের মধ্যে এক জন শিকারী ছিল। আশ্রমের কাছেই বাড়ী বলে প্রতিদিন শিকারে যাওয়ার আগে সে তার গুরুদেবকে প্রণাম করে তবেই শিকারে যেত। একদিন শিকারী গুরুদেবকে জিজ্ঞাসা করল -- আমি সেই ছোটবেলা থেকেই আপনাকে দেখি। রোজ আপনি মালা জপ করেন আর কাঁদেন। আমি তো শিকারের জন্য রোজ জঙ্গলে যাই, কিন্তু আপনি কি শিকারের জন্য এই জঙ্গলে বসে আছেন!
মৃদুস্বরে গুরুদেব উত্তর দিলেন --- আমি যাকে শিকার করতে বসেছি তিনি একখানা আজব জগতের মানুষ! বাবা, তিনি নিজে এক চোর। চুরি করাই তার আবাল্য অভ্যাস। আমার সব কিছুই তিনি চুরি করেছেন। তিনি ভগবান। সেই শ্রীকৃষ্ণ শিকারের জন্যই আমি বসে থাকি।
এই কথা বলেই গুরুদেব অঝোরে কাঁদতে লাগলেন।
শিকারী শিষ্য একেবারেই অপ্রস্তুত হয়ে বলল -- আরে বাবা, আবার কাঁদছ কেন! তোমায় কাঁদতে দেখলে আমি বড় কস্ট পাই। আমাকে একবার বলো সেই চোর ব্যটাকে কেমন দেখতে। আমি ঠিক তাকে ধরে এনে দেব তোমার শ্রীচরণে। তোমার আশীর্বাদে এমন ভাবে জাল ফেলব যে সে ব্যটা পালানোর পথ পাবে না।
গুরুদেব তখন ভগবানের স্বরূপের বর্ণনা তাকে শোনালেন। বললেন --- শ্রীকৃষ্ণ শ্যমবর্ণের, মাথায় ময়ূরের পালক, আর অতি সুন্দর বাঁশরী বাজায়। ভীষণ সুন্দর তাঁর দুটি মায়াবী চোখ।
শিকারী এবার তার গুরুদেবের কাছে শপথ করে বলল --- বাবা, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি আপনার এই শিকার আপনার কাছে না এনে দিতে পারব, প্রতিজ্ঞা করলাম - জল পর্যন্ত আমি গ্রহণ করব না।
শিকারী বনের শুরুর কাছাকাছি পায়ে চলা পথের ধারে এক জায়গায় বড় জাল নিবিড়ভাবে বিছিয়ে বসে গেল।
প্রতিজ্ঞাবাক্য অনুযায়ী জল-অন্ন ছাড়াই সে শিকারের অপেক্ষায় বসে রইল। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিয়ে সে আবারও শিকারের অপেক্ষায় বসে থাকে। এই ভাবে দুই দিন হয়ে গেল। তৃতীয় দিনে তার শরীর খাদ্য-জলের অভাবে দুর্বল হয়ে পড়লেও সে কিন্তু প্রতিজ্ঞার বশবর্তী হয়ে শরীরের মায়া ত্যাগ করে বসেই রইল।
একটু পরে সে একটু ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল। শিকারীর একনিষ্ঠতা ও গুরুভক্তি দেখে এবার করুণাময় ভগবানের খুব দয়া হল। শিকারীর অবস্থা তখন খুবই শোচনীয়। সন্ধ্যার আগে আগে ভগবান বাঁশরী হাতে মন্দগতিতে নিজেই এসে নিঃশব্দে জালে বদ্ধ হয়ে গেলেন।
শিকারী তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এদিকে সন্ধ্যাও হয়ে এসেছে। ভগবান এবার শিকারীর ঘুম ভাঙানোর জন্য মধুর স্বরে বাঁশরী বাজাতে লাগলেন।
অকস্মাৎ বাঁশরীর স্বরে শিকারীর ঘুম ভেঙে গেল। দুর্বল, অবশ শরীরে সে সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে চিৎকার করে উঠল --- শিকার পেয়ে গেছি, আমার শিকার আমি পেয়ে গেছি। আমি আমার গুরুদেবের কাছে করা প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পেরেছি। তিনদিন ধরে ক্ষুধা-তৃষ্ণা ত্যাগ করে, শ্রীকৃষ্ণকে ধরেই ছাড়ালাম তো! আমি ভাগ্যবান, গুরুদেবের চাহিদা আমি পূরণ করতে পেরেছি। জয় গুরু।
শিকারী শ্রীকৃষ্ণকে ঠিক শিকারের মতই জালে মুড়িয়ে, পশুর মতই কাঁধে ঝোলাল, আর শ্রীকৃষ্ণও বিনা শব্দে ঝুলে রইলেন।
'জয়গুরু' বলতেই তার শরীরে যেন শক্তি ফিরে এসেছে! ছুটতে ছুটতে শিকারী তাঁকে গুরুদেবের কাছে এনে কাঁধ থেকে মাটিতে নামিয়ে রেখে বলল --- নাও বাবা, তোমার শিকার আজ আমি নিয়ে এসেছি। তোমার চরণে এই আমার প্রনামী রইল। বল, কোন দিক থেকে কাটব একে।
গুরুদেব দেখলেন শিকারীর কাঁধে ভগবান জালে শান্ত মুর্তিতে বন্দী হয়ে আছেন, মুখে তাঁর রহস্যময় মৃদু হাসি। এখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলেও সাধনকুটিরের চতুর্দিকে আলো বিচ্ছুরিত হয়ে পড়ছে, গাছে পাখীরা ডাকছে, দুরে গ্রামে গৃহস্থ ঘরে সন্ধ্যাকালীন উপাসনার শঙ্খঘণ্টাধ্বনি শোনা যাচ্ছে, বুনোফুলের সৌরভে চারিদিক ম ম করছে।
গুরুদেব তার সাধনকৃত ক্ষীণ তাপসদেহে দৌড়ে গিয়ে ভগবানের চরণে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন -- ভগবান, আমি সেই কৈশোরে ঘর-বাড়ি সব ছেড়েছি তোমাকে পাওয়ার জন্য। বন-জঙ্গল-তীর্থ-মন্দিরে মন্দিরে তোমায় খুঁজেছি দর্শনের আশায়। কত বিচিত্র সাধনা করেছি বিভিন্ন মন্ত্রে। আমার সারাজীবন কাটিয়ে দিলাম তোমার আসার আশায়। কিন্তু তুমি আসনি। কেন আসনি! আমি কি তোমার অযোগ্য ভক্ত? আর আমার শিষ্য, এই শিকারী, মাত্র তিনদিনেই তোমাকে পেয়ে গেল! তোমার এমন বিচার কেন?
ভগবান বললেন --- ভক্ত, সাধকশ্রেষ্ঠ, ওঠ তুমি। তুমি ধন্য। তুমি একজন যোগ্য গুরু। তোমার যোগ্যতা আছে বলেই তো আজ তুমি একজন সফল গুরুদেব। সাধারণ শিকারীকে 'ভগবান-শিকারে' তুমিই পাঠাতে পেরেছ। তোমার সাধনা এখন সফল হয়েছে বলেই তো তুমি সশরীরে আমার চরণ স্পর্শ করতে পেরেছ। আর তোমার শিষ্য, আমাকে না জেনেও, মাত্র তিনদিনেই আমাকে স্পর্শ করতে পেরেছে কারন সে নিঃসংশয় চিত্তে এক গুরুদেবের আশ্রয় নিয়েছে আর গুরুদেবের কর্মের বিচার না করে গুরুবাক্যে আস্থা রেখেছে। সে তিনদিনেই আমার দর্শন পেয়ে গেল তার আরও কারণ সে প্রতিদিনই তোমাকে স্মরন করে, তোমার সুখদুঃখের খবর রেখে তোমার সাধনার শর্ত পুরানোর চেষ্টা করেছে।
এতক্ষণ ধরে শিকারী-শিষ্য একদৃষ্টে তার গুরুদেব ও ভগবানের কথোপকথন শুনছিল। এবার মোটামুটিভাবে সে ঘটনাক্রম সাজিয়ে নিজের মত করে বুঝে নিয়ে ধীর পদক্ষেপে তার গুরুদেবের কাছে পৌঁছে সজল চোখে প্রণাম করতে গুরুদেবের চরণ উদ্দেশ্য করে হাত বাড়াল।
গুরুদেব ত্রস্ত পায়ে এক কদম পিছিয়ে এসে বললেন --- ভক্ত শিকারী, উনি এই বিশ্বচরাচরের সৃষ্টিকর্তা। উনি আমার ইষ্টদেব। আমার ইহকাল-পরকাল, মন-প্রাণের অধিকারী তিনি। এস, ভগবানকে প্রথমে প্রণাম কর।
শিকারী বলল --- শোন বাবা, আমি ভগবান কে বা কি তা কখনও জানিনি বা জানার চেষ্টাও করিনি। আমি চিনি তোমাকে। তোমাকে দেখলে ও তোমার কথা শুনলে আমার প্রানে আনন্দ হয় আর তোমার সাথে কথা বলে শিকারে গিয়ে আমি ভাল ভাল শিকার পাই।
গুরুদেব বললেন --- ভক্ত শিকারী, ভগবান ছাড়া আমরা একপাও চলতে পারি না। তিনিই সব।
শিকারী বলল --- শোন বাবা, তুমিই আমার ভগবান। শ্রীকৃষ্ণ কে - তা আমি আজ জানলাম তোমার কথায় শিকার ধরে নিয়ে এসে, কিন্তু আমি কি ভগবানকে ধরতে গিয়েছিলাম? মোটেই না। আরও শোন, কেউ জানে না, 'জয় গুরু' বলে তোমাকে প্রনাম করে একদিন শিকারে গিয়ে গভীর বনের মধ্যে এক পরিত্যক্ত কুয়োতে আমি গুপ্তধনও পেয়েছি! আর তুমি এই ভগবান ছাড়া আর কি পেয়েছ জীবনে? আমি তোমাকে প্রথমে প্রনাম করে তারপর ভগবানকে প্রনাম করব।
অপ্রস্তুত গুরুদেব কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ভগবান তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন --- ভক্ত সাধক, তোমার শিষ্য তো ঠিকই বলেছে।
শিকারীকে উদ্দেশ্য করে ভগবান বললেন --- বাবা, তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ। যাও, তোমার গুরুদেবকে প্রণাম কর।
শিকারী-শিষ্য এতদিনে বুঝল যে তার গুরুদেব যে সে মানুষ নন। তিনি হলেন রাজার রাজা 'মহারাজ', তিনি সাধনভজনে রত -- শিষ ধরতে ঘুরে বেড়ান না। তার গুরুদেবের ভক্তিসাধনায় স্বয়ং বিশ্বনাথ সাধনকুটিরে উপস্থিত হয়েছেন দর্শন দিতে। শিকারী-শিষ্য দু'হাত বাড়িয়ে, তার অভ্যাসমত, পঞ্চাঙ্গে গুরুদেবকে প্রণাম করল।
শিষ্যের প্রণাম গ্রহন করে গুরুদেব তার মস্তক স্পর্শ করে আশীর্বাদ করে বললেন --- বাবা, ভগবানকে প্রণাম কর আর তুমি আমার সাধনকুটিরের দায়িত্ব নিয়ে সাধন জগতে প্রবেশ কর। আমি ভগবানের দর্শন পেয়ে আবাল্য লালিত স্বপ্নপূরন করেছি। আমি অন্যত্র গমন করব।
গুরুদেব ভগবানকে সশ্রদ্ধ প্রণাম করলে তিনি আশীর্বাদ করলেন --- তোমার সকল ইচ্ছা পূরন হোক্।
ভগবানের কথা শুনে গুরুদেবের দুই চোখে জলের স্রোত বয়ে গেল। আনন্দে তিনি এতটাই শিহরিত হলেন যে আনন্দ-কম্পণে তার হৃৎকম্প শুরু হল। তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই ভগবানের সামনেই কয়েক মুহুর্তের মধ্যে দেহ ত্যাগ করলেন।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার- রতন কর্মকার-বাংলাদেশ ঢাকা,
জয় গুরু মহারাজ 🙏🙏🙏