আচার্য রামানুজ
১০১৭ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণাত্যের পেরেমবুদুরে আচার্য রামানুজের জন্ম হয়।
তার পিতা পণ্ডিতপ্রবর কেশবাচার্য। আর মায়ের নাম কান্তিমতী।
মা এবং বাবা দাক্ষিণাত্যের পার্থসারথি মন্দিরে দীর্ঘদিন আরাধনা
করেছিলেন। এর ফলেই তারা রামানুজকে পুত্র সন্তান হিসাবে লাভ করেন।
বৌদ্ধ এবং শঙ্কর যুগের পর যিনি ভক্তিবাদী আচার্য হিসাবে তার
শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন, তিনি হলেন রামানুজ। তিনি বিশিষ্টাদ্বৈতবাদকে
স্থাপন করেন। ভগবত প্রেম এবং শরণাগতির পরমতত্ত্ব প্রকাশ করেন।
তার বিষ্ণু উপাসনা এবং ভক্তি আন্দোলনের ফলে পরবর্তীকালে একাধিক
আচার্যের আবির্ভাব হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে মাধব নিম্বার্ক, বল্লভ, চৈতন্য
প্রভৃতি প্রধান।
একেবারে ছােটোবেলা থেকে রামানুজ ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত। পিতার
কাছ থেকে পেয়েছিলেন জ্ঞানতৃষ্ণা এবং মায়ের কাছ থেকে ভক্তিপ্রবণতা।
তার মামা ভক্তি সাধক শৈলপূর্ণ ছিলেন পরম বৈষ্ণব যামুনাচার্যের
শ্রেষ্ঠ শিষ্য।
ছাত্র হিসাবেও রামানুজের কোনাে তুলনা ছিল না। কাঞ্চির বিখ্যাত
অদ্বৈতবাদী আচার্য যাদব প্রকাশের কাছে বেদ অধ্যয়ন করেন। তাঁর মেধা
দেখে যাদব প্রকাশ খুবই খুশি হয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন ভবিষ্যতে
এই ছাত্রটি তাঁর মতবাদের ধারক ও বাহক হয়ে উঠবেন। কিছুদিন পর
যাদব প্রকাশ বুঝতে পারলেন, এর মধ্যে অন্য সম্ভাবনা আছে। একদিন
এঁর প্রভাবে তার খ্যাতিও ম্লান হয়ে যাবে। মন্ত্রবিদ্যাতেও যাদব প্রকাশ সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। সেবার কাঞ্চিরাজের
কন্যার ওপর প্রেতাত্মা ভর করেছিল। কোনাে চিকিৎসাতে ফল পাওয়া
গেল না। তখন যাদব প্রকাশের কাছে আহ্বান এল। তিনি মন্ত্রশক্তি প্রয়ােগ
করে কন্যাকে প্রেতাত্মার হাত থেকে মুক্ত করেছিলেন। আচার্য প্রবরের
উপস্থিতিতে প্রেতাত্মা রাজকুমারীর মুখ দিয়ে বলেছিল—“তােমার শিষ্য
রামানুজ এক বিষ্ণু ভক্ত ব্রাহ্মণ, সে যদি আমার শিরে পদস্পর্শ করে
তাহলে আমি রাজকুমারীকে ছেড়ে চলে যাব।
অগত্যা রামানুজের ডাক পড়ল। প্রেতাত্মা রাজকন্যাকে ছেড়ে চলে
গেল। এই ঘটনায় সর্বত্র রামানুজের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল।
যাদব প্রকাশ রামানুজকে সহ্য করতে পারলেন না। তিনি তার প্রিয়
শিষ্যকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করলেন। বিন্ধ্যপ্রদেশের গােণ্ডা অরণ্যে
উপস্থিত হয়ে তাকে হত্যা করবেন বলে স্থির করলেন। রামানুজের
মাসতুতাে ভাই গােবিন্দ ছিলেন যাদব প্রকাশের শিষ্য। তিনি ষড়যন্ত্রের
কথা জানতে পেরে রামানুজের কাছে তা প্রকাশ করলেন। রামানুজ
কোনােরকমে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে নিজেকে রক্ষা করলেন।
অবশেষে যাদব প্রকাশ তাকে আশ্রম থেকে বিতাড়িত করেছিলেন।
রামানুজের জীবনে বেশ কয়েকটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা ঘটে যায়।
তার মধ্যে শ্রীরঙ্গম মঠের মঠাধ্যক্ষ যমুনাচার্যের সঙ্গে যােগাযােগের কথা
বলতে হবে। যমুনাচার্য রামানুজকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই
তরুণ সাধক একদিন ভারত সাধক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবেন। তিনি
রামানুজ সম্পর্কে একটি শ্লোকে বলেছিলেন—“হে কমল নয়নে শ্রীপতে,
রামানুজের ওপর তােমার কৃপা স্থাপন করে তাকে স্বীয় মতে আনয়ন
করাে নাথ।”
যমুনাচার্যের আহ্বানে রামানুজ এলেন শ্রীরঙ্গমে। তখন যমুনাচার্য
শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তবে তার হাতের তিনটি আঙ্গুল মুদ্রিত অবস্থায় আছে। রামানুজ তার অভিপ্রায়ের কথা বুঝতে পারলেন। তিনি
মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে জীবনের সঙ্কল্প নিলেন—এখন থেকে তাকে
ঈশ্বর আরাধনায় মগ্ন থাকতে হবে। শুধু তাই নয়, তিনি বিষ্ণুর নাম সর্বত্র
প্রচার করবেন।
কাঞ্চিনগরে ফিরে এসে রামানুজ বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থ রচনাতে
মনােনিবেশ করেছিলেন। এর পাশাপাশি বরদারাজনের ধ্যান করতে
থাকলেন। ইতিমধ্যে তার বিয়ে হয়েছে। পিতৃদেবের মৃত্যু হয়েছে।
যামুনাচার্যের মৃত্যুর পর তিনি হলেন শ্রীরঙ্গম মঠের অধ্যক্ষ। সবসময়
তিনি রঙ্গনাজীর পুজো নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।
মঠের বিভিন্ন কাজকর্মের দায়িত্ব দেওয়া হল রামানুজের ওপরে।
পণ্ডিত প্রবর মহাপূণ্য স্বামীকে রামানুজের কাছে কাঞ্চিতে পাঠানাে হল।
তিনি রামানুজ এবং তার স্ত্রী দিসাম্বাকে বৈষ্ণব মন্ত্রে দীক্ষিত করলেন।
রামানুজ এবার তার সঙ্কল্পকে পূর্ণ করে তােলার জন্য ব্যাকুল হয়ে
উঠলেন। তিনি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটালেন।
অলৌকিকভাবে তিনি বরদা রাজের কাছ থেকে দীক্ষামন্ত্র লাভ
করেছিলেন।
এই নবীন সন্ন্যাসীকে দেখতে অনেক মানুষের ভিড় জমে গেল।
ধীরে ধীরে তিনি বরদারাজ মঠের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন। প্রতিদিন মেতে
থাকেন শাস্ত্র আলােচনার মধ্যে। সহজ সরল ভাষায় ভক্তিধর্মের ব্যাখ্যা
তুলে ধরলেন মানুষের কাছে।
কুরেশ ছিলেন তার প্রথম শিষ্য। এবার এগিয়ে এলেন বাৎস্যনাথ
দাশরথি প্রমুখ মহাত্মারা।
একদিন বড়াে রঙ্গস্বামী কাঞ্চীতে এসে বরদরাজ ভগবানকে প্রণাম
করলেন। রামানুজকে সঙ্গে নিয়ে এলেন শ্রীরঙ্গমে। শিষ্যসহ রামানুজ
শ্রীরঙ্গমে প্রবেশ করলেন। তারপর মানুষের মধ্যে ভক্তিবাদের কথা প্রচার
করতে থাকলেন। এরপর রামানুজ বিভিন্ন আচার্যের কাছ থেকে নানা বিষয়ে শিক্ষালাভ করেন । সুদীর্ঘকাল ধরে তিনি জ্ঞানার্জন এবং জ্ঞান সাধনা করেছেন । ধীরে ধীরে একটি সম্প্রদায়ের গুরু হয়ে ওঠেন । এই সম্প্রদায়কে বলা হয় । রামানুজ সম্প্রদায় । তখন তিনি শ্রীরঙ্গমঠের মঠাধ্যক্ষ । তার জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের কথা সমগ্র দাক্ষিণাত্যে ছড়িয়ে পড়েছে । মায়াবাদী সন্ন্যাসীদের তিনি পরাস্ত করেছেন । এমনকি শক্তিধর সন্ন্যাসী যজ্ঞমূর্তিকেও তর্কবিচারে হারিয়ে দিলেন । পরবর্তীকালে যজ্ঞমূর্তি বিষ্ণুপন্থী সাধক রূপান্তরিত হন । রামানুজের নির্দেশে তামিল ভাষায় ‘ জ্ঞানসার ’ এবং প্রমেয়সার ’ নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেন । রামানুজ বেদান্তসার , বেদান্ত সংগ্রহ , বেদান্তদীপ , শ্রীভাষ্য শ্রীমদ্ভগবত গীতা প্রভৃতি অনন্য সাধারণ গ্রন্থপঞ্জী রচনা করেছিলেন । তখন চোল রাজ্যের রাজা ছিলেন শৈব ধর্মাবলম্বী । তিনি বৈষ্ণব বিদ্বেষী হিসাবে কুখ্যাত ছিলেন । তিনি বৈষ্ণব রামানুজের প্রভাব প্রতিপত্তি সহ্য করতে পারলেন না । রামানুজকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন । দূত পাঠিয়ে তাঁকে রাজসভায় আহ্বান করলেন । রামানুজের অন্তরঙ্গ শিষ্যরা রাজার অভিপ্রায় বুঝতে পেরেছিলেন । তাই তারা গুরুকে রাজদরবারে যেতে দিলেন না । শিষ্য কুরেশ রামানুজের বেশ ধারণ করে রাজসভায় উপস্থিত হলেন । সঙ্গে গেলেন আরেক শিষ্য মহাপূণ্যস্বামী । রাজা তাকেই রামানুজ স্বামী বলে বিশ্বাস করলেন । ইতিমধ্যে রামানুজ চোল রাজ্য ছেড়ে মেলকোটে চলে গেছেন । সেখানকার জৈন আচার্যদের তর্কযুদ্ধে পরাস্ত করলেন । তারা সকলে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নিলেন । দাক্ষিণাত্যের পশ্চিমাঞ্চলের সাধারণ মানুষের মধ্যে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করলেন ,
চোলরাজা কুরেশকে রামানুজ মনে করে তার দুটি চোখ অন্ধ করে দিয়েছিলেন । মহাপূণ্যস্বামীর চোখও অন্ধ করে দেওয়া হল । এই অন্যায় কাজ করার কিছুদিনের মধ্যে চোলরাজের মৃত্যু হল । মেলকোটে অবস্থান কালে রামানুজ একদিন স্বপ্ন দেখলেন । সেই স্বপ্নে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ এসেছিলেন । তিনি বললেন — আমি এই মেলকোটের মাটির নীচে অবস্থিত আছি । তুমি আমাকে উদ্ধার করাে । এখানে যে শ্বেত মৃত্তিকা আছে তা ধারণ করাে । অতঃপর আনন্দ - ব্যাকুল হৃদয়ে রামানুজ স্বামী কল্যাণ সরােবরে স্নান । করে শ্রীবিগ্রহ উদ্ধার করলেন । এই বিগ্রহ আবার একদিন তাকে স্বপ্নে বলেছিলেন — আমার একটি প্রতীক বিগ্রহ আছে , তার নাম সম্পদকুমার । সেটি এখন দিল্লির মুসলমান । সম্রাটের অন্তঃপুরে আছে । তুমি তাকে এখানে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা । কয়েকজন অন্তরঙ্গ শিষ্যকে নিয়ে রামানুজ চললেন দিল্লির পথে । দিল্লির সম্রাট তাঁর সঙ্গে দেখা করে খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন । আচার্য লুণ্ঠিত শিলাবিগ্রহটি ফেরত দেবার জন্য সম্রাটের কাছে অনুরােধ করলেন । সম্রাট বিগ্রহটিকে সন্ন্যাসীর হাতে সমপর্ণ করলেন । বিগ্রহটিকে হাতে পেয়ে রামানুজ স্বামী অতি দ্রুত মেলকোটের দিকে যাত্রা করলেন । সম্রাট নন্দিনী লছিমা তখন ছিলেন দিল্লির বাইরে ।
প্রাসাদে ফিরে এসে তিনি বিগ্রহটিকে দেখতে না পেয়ে খুবই অস্থির হয়ে উঠলেন । তিনি পিতাকে বললেন , বিগ্রহটিকে ফিরিয়ে আনতে । সম্রাট একদল অশ্বারােহীকে পাঠালেন বিগ্রহটিকে ফিরিয়ে আনার জন্য , সঙ্গে লছিমা এবং তার প্রেমিক কুবের ছিলেন । রামানুজ আগে থেকেই এই বিষয়টি বুঝতে পরেছিলেন । তাই তিনি অত্যন্ত দুর্গম পথের মধ্যে দিয়ে মেলকোটে পৌঁছে গিয়ে বিগ্রহের প্রতিষ্ঠার কাজ সুসম্পন্ন করলেন । তখন লছিমা এবং কুবের সেখানে এসে পৌঁছলেন । হিন্দু বিগ্রহের প্রতি মুসলমান কন্যার এই ভালােবাসা রামানুজকে অবাক করে দেয় । রামানুজ বিষ্ণু মন্দিরে লছিমাকে প্রবেশের অনুমতি দিলেন । লছিমা আর সেখান থেকে ফিরে আসেননি । জনশ্রুতি আছে , ভক্তিমতী খছিনা নাকি সম্পদকুমারের বিগ্রহের মধ্যে লীন হয়ে গিয়েছিলেন । তার প্রেমিক কুবের স্বপ্নাদেশ পেয়ে নীলাচল অর্থাৎ পুরীতে যান এবং পরম বৈষ্ণব সাধক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন । এবার রামানুজ সম্পদকুমার এবং মূল বিগ্রহকে প্রণাম করে কয়েকজন শিয্যের হাতে এই মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সমর্পণ করলেন । তারপর শ্রীরঙ্গমের পথে যাত্রা করলেন । সেখানে গিয়ে শাস্ত্র ব্যাখ্যার মধ্যে দিয়ে তার দিন কেটে যায় । কিছুদিনবাদে তিরুপতিতে গােবিন্দরাজের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন । তিনি দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন স্থানে আরও কতকগুলি বিগ্রহ স্থাপন করেছিলেন । রামানুজ স্বামী ছিলেন এক বিরল শ্রেণীর সন্ন্যাসী । তার মধ্যে জ্ঞান , কর্ম এবং ভক্তি — এই তিনটি ভাবের সমন্বয় ঘটে গিয়েছিলন । তিনি তীব্র সাধনা এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সমগ্র দক্ষিণ ভারতে বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করেন । ভারতবর্ষের বৈষ্ণব আচার্যেরা নানাভাবে তার কাছে ঋণ । স্বীকার করে গেছেন । ১১৩৭ খ্রিস্টাব্দের মাঘী শুক্লা দশমীতে ১২০ বছর বয়সে এই মহাপুরুষের মহাপ্রয়াণ হয় ।