Type Here to Get Search Results !

   Choose Your Language   

বিষ্ণুপ্রিয়া দেবি😊,Vishnupriya Devi biography in Bengali, Bishnupriya Devi biography Bengali, বিষ্ণুপ্রিয়া দেবি, lady sant, all Indian monk biography in Bengali, indian famous Hindu monk biography Bengali,


 কৃষ্ণসাধিকা বিষ্ণুপ্রিয়া 

আমাদের দুর্ভাগ্য , আমরা চৈতন্য পত্নী বিষ্ণুপ্রিয়া সম্পর্কে খুব একটা আগ্রহী নই । তিনি ছিলেন একাধারে চৈতন্যের স্বরূপ শক্তি , সহধর্মিণী এবং শিষ্যা । পঞ্চদশ শতকে নবদ্বীপ ছিল সারা ভারতের বিদ্যাচর্চার অন্যতম কেন্দ্র । এই বিদ্যাকেন্দ্রের অন্যতম পণ্ডিত ছিলেন সনাতন মিশ্র । তিনি বিষ্ণুপ্রিয়ার পিতা । মায়ের নাম মহামায়া । এই সুপণ্ডিত এবং বিত্তবান পিতার সংসারে ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে বিষ্ণুপ্রিয়া জন্মগ্রহণ করেন । কন্যা কৈশােরে পদার্পণ করার সঙ্গে সঙ্গে মা - বাবা তার বিবাহ সম্পর্কে চিন্তা করতে থাকেন । এই সময় স্থানীয় পণ্ডিত কাশীনাথ তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিবাহের প্রস্তাব দেন । পাত্র পণ্ডিত জগন্নাথ মিশ্রের পুত্র বিশ্বম্ভর । পাণ্ডিত্য এবং প্রতিভার দিক থেকে নবদ্বীপের সারস্বত সমাজে তার জুড়ি নেই । এই বিয়ের প্রস্তাব শুনে সনাতন মিশ্র খুবই খুশি হয়েছিলেন । শুভদিনে বিবাহ অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন হল । শচীদেবী পরম সমাদরে পুত্রবধূকে বরণ করে ঘরে তুললেন । আজ তার বড়াে আনন্দের দিন । এই জীবনে পুত্র কন্যার শােক তাকে কম সহ্য করতে হয়নি । প্রতিভাধর তরুণ পুত্র বিশ্বরূপকে হারিয়েছেন । বিশ্বরূপ সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করেছেন । শেষ অবদি জয়ী হয়েছেন তিনি , আজ নিমাই পণ্ডিতের নাম সর্বত্র পৌঁছে গেছে । নিমাই অর্থাৎ বিশ্বম্ভরও খুশি হয়েছেন এই বিবাহে । কিশােরী বিষ্ণুপ্রিয়া অনিন্দ্যসুন্দরী , গুণে আর বুদ্ধির ঔজ্জ্বল্যে তিনি অতুলনীয়া । রাজপণ্ডিত । সনাতন তার একমাত্র কন্যাটিকে রাজরানির মতােই গড়ে তুলেছেন । বিশ্বম্ভরের দিন কাটে বিষ্ণুপূজা , অধ্যাপনা , গঙ্গাস্নান ও বিদ্যাচর্চার কাজে । স্বামীকে সাধ্যমতাে সহযােগিতা করেন বিষ্ণুপ্রিয়া । সব অর্থে তিনি ছিলেন স্বামীর অনুগামিনী । এইভাবেই বিশ্বম্বর এবং বিষ্ণুপ্রিয়ার দাম্পত্য জীবন সুখ শান্তিতে ভরে ওঠে । অধিক রাত্রে স্বামী বিদ্যাচক্র থেকে গৃহে ফিরতেন । তারপর বসতেন বিষ্ণুপুজায় । এরপর জননী শচীদেবী এবং বধূ বিষ্ণুপ্রিয়া সযত্নে আহার্য পরিবেশন করতেন । তারপর শয়নগৃহে স্বামীকে একান্তে সেবার অধিকার পেতেন বিষ্ণুপ্রিয়া । এই মুহূর্তের জন্যই সারাদিন । থাকতেন তিনি প্রতীক্ষিতা । বিয়ের পর থেকে যে স্বামীকে বিষ্ণুপ্রিয়া দেখেছেন , তিনি কন্দর্পকান্তি , নয়ন মনােলােভা পুরুষ । যুবা বয়সেই অপরিসীম তার ব্যক্তিত্ব ও পাণ্ডিত্য । নদীয়ার শীর্ষস্থানীয় অধ্যাপক হিসাবে তাঁর খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে । সব চাইতে বড়াে কথা বিষ্ণুপ্রিয়ার প্রতি তাঁর অনুরাগের কোনাে তুলনা নেই । স্বামী সােহাগিনী তরুণী বিষ্ণুপ্রিয়ার এই সুখ কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হয় । বিধির বিধানে একদিন এই সৌভাগ্যময় জীবনে ছেদ পড়ে গেল । জীবনের সর্বস্ব স্বামীকে চিরতরে হারালেন বিষ্ণুপ্রিয়া । স্বামী সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন । এর অন্তরালে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা উচিত । সেবার গয়ায় পিতৃকার্য করতে গিয়েছিলেন বিশ্বম্ভর পণ্ডিত । বিষ্ণুপাদ দর্শন করার সঙ্গে সঙ্গে তার জীবনে আমূল পরিবর্তন হয়ে গেল । তিনি বুঝতে পারলেন সংসার জীবন তাকে আর আকৃষ্ট করতে পারবে না । ঈশ্বরপুরীর কাছ থেকে দীক্ষিত হলেন । দিব্যোম্মাদ অবস্থায় নবদ্বীপে ফিরে এলেন । স্বামীকে দেখে বিষ্ণুপ্রিয়া বুঝতে পারলেন , তার কপাল পুড়েছে । এ কী অবস্থা হয়েছে বিশ্বম্ভরের ? সাংসারিক কোনাে বিষয়ের প্রতি বিন্দুমাত্র আসক্তি নেই । সর্বদা নামসংকীর্তন করে চলেছেন । শেষ পর্যন্ত তিনি জননী শচীদেবীকে জানালেন তার সঙ্কল্পের কথা । তিনি সন্ন্যাস ব্রত অবলম্বন করবেন । আর্তস্বরে কেঁদে উঠলেন জননী । বুঝতে পারলেন , কিছুতেই তিনি কনিষ্ঠ পুত্রের পথ রােধ করতে পারবেন না । খবর পৌঁছল বিষ্ণুপ্রিয়ার কানে । বিষাদ আর দুশ্চিন্তার মেঘ ঘনিয়ে এল তার মনের আকাশে । নানাভাবে তিনি বিশ্বম্ভরকে বােঝাবার চেষ্টা করেছিলেন । পতিকে জড়িয়ে ধরে ভেঙে পড়েছিলেন কান্নায় । বলেছিলেন— “ আমি শুনেছি সব কথা । আমায় চিরতরে ত্যাগ করে তুমি সন্ন্যাস নেবে , কিন্তু কেন ? কী আমার অপরাধ , তা স্পষ্ট করাে বলাে । ” বিশ্বম্ভর নানাভাবে তরুণী পত্নীকে বােঝাবার চেষ্টা করেছিলেন । কিন্তু এই কাজে তিনি সফল হননি । শেষ অবধি বিষ্ণুপ্রিয়া বললেন— “ আমি বুঝেছি , আমি হচ্ছি তােমার ঈশ্বর আরাধনার প্রধান অন্তরায় । তাই তুমি সংসার ত্যাগ করে চলে যাচ্ছাে । বরং আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাই , বাকি জীবনটা আমি বাপের বাড়িতে কাটিয়ে দেব , তােমার পায়ে পড়ি , তবু তুমি এখানে থাকো । ” পত্নীকে কাছে টেনে নিয়ে বিশ্বম্ভর বলেছিলেন— “ তুমি আমার পথের বাধা নও , বিষ্ণুপ্রিয়া । আমি কৃষ্ণের জন্য ব্যাকুল , কৃষ্ণের সান্নিধ্য আমাকে পেতেই হবে । ” অবশেষে এল সেই শুভ মুহূর্তটি । ১৫১০ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে সংসার আশ্রম ত্যাগ করলেন বিশ্বম্ভর । গভীর রাত্রি । প্রাণপ্রিয়া বিষ্ণুপ্রিয়া সজ্জায় শুয়ে নিদ্রায় অভিভূত । পত্নীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন বিশ্বম্ভর । তারপর দ্রুতপদে ছুটে গেলেন পাপের দিকে । বিষ্ণুপ্রিয়া জেগে উঠলেন তার নিদ্রা থেকে । তাকিয়ে দেখলেন স্বামী শয্যায় শায়িত নেই । বাইরে থেকে শােনা যাচ্ছে শচীমাতার ব্যাকুল কণ্ঠস্বর । আলুথালু বেশে ছুটে গিয়ে দ্বার খুলে দিলেন বিষ্ণুপ্রিয়া । তারপর বুঝতে পারলেন , যা সর্বনাশ হবার তা হয়ে গেছে । এক মুহূর্তে নিজের এই দুর্দৈবকে উপলব্ধি করলেন বিষ্ণুপ্রিয়া । মােহাচ্ছন্ন অবস্থায় বেশ কয়েকদিন কেটে গেল । তারপর তিনি বুঝতে পারলেন এ হল বিধির বিধান । তাকে এখন নতুন জীবনের জন্য নিজেকে তৈরি করতে হবে । সেই জীবনে আছে বিরহের যন্ত্রণা , আছে শােকার্ত মুহূর্তের অনুভূতি আর আছে কৃষ্ণপ্রেমে উন্মাদিনী হবার উপলব্ধি । কিছুদিন বাদে বিশ্বম্ভর রাজী হলেন মাতা এবং স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে । সেই মতাে সংবাদ গেছে নিত্যানন্দের কাছে । কিন্তু নিত্যানন্দ নিষ্ঠুরের মতাে বললেন— “ মা , প্রভু বলে দিয়েছেন শুধু তুমি শান্তিপুরে যাবে । শ্ৰীমতীর যাবার কোনাে নির্দেশ নেই । ” এই কথা শুনে বিষ্ণুপ্রিয়া অবাক হয়ে গেলেন । বুঝতে পারলেন কেন । তার মুখদর্শন করতে চাইছেন না বিশ্বম্ভর । তিনি শান্ত , স্থির কণ্ঠস্বরে বললেন— “ মা , আমি তার কাছে গেলে সন্ন্যাসব্রত ভঙ্গ হবে । তাই তিনি আমাকে যেতে বারণ করেছেন । আমি সহধর্মিণী , তার আচরিত ধর্ম রক্ষা করাই আমার কর্তব্য । আপনি কেন যাবেন না ? উনি যে আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছেন । ” এইভাবে বিষ্ণুপ্রিয়া শচীমাতাকে পাঠিয়ে দিলেন । তারপর ভেঙে পড়লেন আকুল কান্নায় । স্বামী - ভাগ্যে সমস্ত নদীয়ায় তিনি ছিলেন । অতুলনীয়া । সেই পরম পাওয়াকে হারিয়ে আজ তিনি নিঃস্ব রিক্ত ভিখারিণী হয়ে গেছেন । বিরহের আগুন ধিকিধিকি জ্বলে ওঠে বিষ্ণুপ্রিয়ার মনের মধ্যে । নতুন পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিলেন । এখন সন্ন্যাসের পথই বেছে নিয়েছেন । তার স্বামী । তাই ভােগের পথ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখলেন বিষ্ণুপ্রিয়া । শুরু হল কঠোর বৈরাগ্য আর তপস্যাময় জীবন । রাত্রি শেষের অন্ধকার যখন ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসে , নিশান্তিকার আলােয় চারপাশ হয় উদ্ভাস , তখন গঙ্গায় স্নান করেন বিষ্ণুপ্রিয়া । এবার বিষ্ণুপূজার কক্ষে বসে পতিদেবতার কাঠের পাদুকার সামনে ধ্যান এবং জপে নিবিষ্ট হন । 


বেলা বেড়ে গেলে শাশুড়ির আহার এবং সেবা পরিচর্যার জন্য কিছুটা সময় কাটান । বাকি সময়টা কেটে যায় ইষ্টদেবতার আরাধনায় । স্বামীর নির্দেশানুসারে পরম প্রভু কৃষ্ণকে তার ইষ্ট দেবতা হিসাবে গ্রহণ করেছেন । সমস্ত রাত ধরে চলে এই ভজন সাধনের পালা । একদিন কথায় কথায় বিশ্বম্ভর বলেছিলেন- “ আমি যেমন কৃষ্ণের ভজন করছি , কৃষ্ণরসে মজে আছি , তুমিও তেমন করাে । কৃষ্ণ সত্তার ভেতর দিয়েই ঘটবে আমাদের মিলন , আর সেই মিলন হবে ছেদহীন , অন্তহীন । ” সন্ন্যাসব্রত অবলম্বন করার পরেও গৌরাঙ্গ কিন্তু মাতা ও পত্নীকে বিস্মৃত হননি । প্রতি বছর গৌড়ীয় ভক্তরা তার সঙ্গে দেখা করতে নীলাচলে যেতেন । প্রভু তাদের সঙ্গে শচীদেবীর জন্য নানা ধরনের প্রসাদ আর বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্য একটি বহুমূল্য শাড়ি পাঠাতেন । বিষ্ণুপ্রিয়ার উদ্দেশ্যে এই শাড়িটি দিতেন চৈতন্যের পরম ভক্ত ওড়িশার রাজা প্রতাপ রুদ্র গজপতি । আর বিষ্ণুপ্রিয়া ? তিনি ওই শাড়িটি ভক্তি ভরে গ্রহণ করে একটি পেটিকায় রেখে দিতেন । মাঝে মধ্যেই এই পবিত্র স্মারক বস্তুটি খুলে দেখতেন । সঙ্গে সঙ্গে সব কথা তার মনে পড়ে যেত । তিনি বুঝতে পারতেন স্বামী এখন অনেক জনের মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন । কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়ার প্রতি তার ভালােবাসা এতটুকু কমেনি । এতাে কম কথা নয় । এবার শচীদেবীর বিদায় গ্রহণের পালা । নিমাইয়ের বিচ্ছেদ বেদনা তিনি বেশিদিন সহ্য করতে পারেননি । রােগে , শােকে জর্জরিত হয়ে শয্যা গ্রহণ করলেন । তারপর একদিন ইহলীলা ত্যাগ করলেন । এইভাবে বিষ্ণুপ্রিয়ার সংসার জীবনের শেষ বন্ধনটি ছিন্ন হয়ে গেল । নিঃসঙ্গতার মধ্যে শুরু হল তাপসী বিষ্ণুপ্রিয়ার জীবন সাধনা । এখন নিজেকে আরও একাকীত্বের মধ্যে রাখলেন তিনি । শুধু খিড়কির দুয়ারটি রইল খােলা । এই দুয়ার দিয়ে তিনি শেষ রাতে গঙ্গায় স্নান করতে যেতেন । তারপর কঠোরতম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিজেকে বেঁধে রাখলেন । ভজন - পূজন এবং ধ্যানের শেষে নামজপে বসতেন । সহস্রবার জপ হয়ে গেলে একটি তণ্ডুলকণা পাশে সরিয়ে রাখতেন । এইভাবে দিন শেষে দুমুঠো চাল সঞ্চিত হতাে । তারপর শাকপাতা দিয়ে তা সেদ্ধ করে প্রস্তুত করতেন রােজের আহার্য । এইভাবেই চলত তার জীবন ধারণ । অভিভাবিকা শচীমাতা এখন আর জীবিত নেই , সুতরাং বিষ্ণুপ্রিয়া আরও বেশি কৃচ্ছ্বসাধনের পথ অবলম্বন করলেন । বিরহসাধনার মধ্যে দিয়ে নিজেকে পরম পুরুষের সাথে করার চেষ্টা করলেন মিলিত এই বিরহের মধ্যে একটি দার্শনিক তত্ত্ব লুকিয়ে আছে । এই তত্ত্বের রূপায়ণ ঘটেছিল বিষ্ণুপ্রিয়ার মধ্যে । স্বামীরূপে যে বিশ্বম্ভর ছিলেন তার পরম আত্মীয় আর অহঙ্কারের বস্তু , সেই স্বামীকে তিনি কি পেয়েছিলেন এই কঠিন কঠোর তপস্যার অন্তে ? কিশােরী জীবনে ছিলেন এক কলহাস্য মুখরিতা রমণী , মধ্যবয়সে হয়ে গিয়েছিলেন বারুদ্ধা । পঁচাশি বছরের অন্তে জীবন দীপ নির্বাপিত হয় । এতদিন ধরে তিনি যাঁর সাধনা করেছেন , শেষ অবধি বােধহয় সেই ঈশ্বরের শ্রীচরণ দর্শন করতে সমর্থ হলেন ।


Power by: © YogiKathaOfficial

                   www.yogsiddhi.in

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.