Type Here to Get Search Results !

   Choose Your Language   

গুরু নানক | Gurunanak Biography Bengali | All Indian monk biography Bengali

গুরু নানক


এক ওঁকার এক ও অদ্বিতীয় । পরমেশ্বর রূপে তিনি বিরাজ করছেন । সৎ তার নাম , তিনিই সৃষ্টিকর্তা , তিনিই অনাদন্ত পুরুষ । তিনি ভয় রহিত , তার কোনাে শত্রু নেই । মূর্তি তার কালের দ্বারা নয় পরিচ্ছন্ন । তিনি অযােনিসম্ভব — স্বয়ম্ভু । গুরুর প্রসাদে শুধু তার নাম জপ করাে । এমন কথা কে বলেছেন ? জপ , শুধু জপের মাধ্যমে আমরা সমস্ত বিপদ কাটাতে পারব । তত্ত্ব উপলব্ধির প্রধান উপায় হল — এক মনে জপ করা । গুরুমুখী হয়ে গুরুর কৃপার ওপর নির্ভর করে এই জপ সাধন । করতে হবে । তিনি বারবার একথাই বলেছেন যে , সৎ নাম শ্রবণ করলে অযােগ্য । ব্যক্তিও স্তুতিযােগ্য হয় । এই নাম শ্রবণে যােগােক্ত ষট্‌চক্রভেদ করা সম্ভব হয় । জানা যায় বেদের অন্তর্নিহিত অর্থ । এই নাম শ্রবণ করলে ভক্তের হৃদয়াকাশ সর্বদা আনন্দে বিরাজ করে । দুঃখ এবং পাপের বিনাশ হয় । তিনি হলেন গুরু নানক । যে নানক জাতিভেদ প্রথা মানতেন না । যে নানক আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতে যে , হিন্দু ও মুসলমান ধর্মের মধ্যে এমন কিছু অন্তর্নিহিত অর্থ আছে , যার মধ্যে সাদৃশ্য বর্তমান । অথচ আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভুলে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিদ্বেষপূর্ণ বাতাবরণ সৃষ্টি করেছি । নানক জাতিভেদ মানতেন না । তাঁর সারাজীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সমস্ত ধর্মের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা । তিনি যে ধর্মমত প্রচার করেন তাকে শিখধর্ম বলা হয় । শিখ শব্দটির অর্থ হল শিষ্য । নানক জাতি - বর্ণ - ধর্ম - অর্থ নির্বিশেষে সকলকেই তার শিষ্যত্বে বরণ । করেছিলেন । নানকের জন্ম হয় পাঞ্জাব প্রদেশে , ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দের বৈশাখ মাসে । তিনি জন্মেছিলেন লাহাের থেকে তিরিশ মাইল দূরে গুজরানওয়ালা জেলার তালওয়ান্দি গ্রামে । বর্তমানে এই গ্রামটির নাম নানকানা । নানকের বাবার নাম ছিল কালুবেদি । মায়ের নাম তৃপ্তা । কালুবেদি জাতিতে ক্ষত্রিয় ছিলেন । তিনি একটি জমিদারির সেরেস্তায় হিসাব নিকাশের কাজ করতেন । তার কিছু জমিজমাও ছিল । বাল্যকাল থেকেই নানকের মধ্যে বৈরাগ্যভাব দেখা যায় । সমবয়সী বন্ধুদের সাথে খেলাধুলায় মেতে উঠতেন না । সন্ন্যাসী দেখলেই ছুটে যেতেন । তাদের মুখনিঃসৃত অমৃতবাণী শ্রবণ করতেন । নিজের মনে সন্ন্যাসীর গুণাগুণ বিচার করতেন । সেই বয়সেই ভালােমন্দ বিচার করার দক্ষতা জন্মেছিল নানকের । গ্রামবাসীরা এই ভাবপ্রবণ বালকটিকে দেখে অবাক হয়ে যেতেন । তারা ভাবতেন এই বালকের মধ্যে নিশ্চয় ঈশ্বরের করুণা বিরাজ করছে । তথাকথিত শিক্ষার দিক থেকে নানক খুব একটা অগ্রসর হতে পারেন । নি । ভালােবাসতেন প্রকৃতির রাজ্যে বিচরণ করতে । প্রকৃতির নানা অমােঘ । ঘটনার অন্তরালে কোন সত্যি লুকিয়ে আছে , তা জানতে চাইতেন । অল্প বয়সেই তিনি ফারসি ভাষাতে যথেষ্ট দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন । এর পাশাপাশি । যত্ন করে সংস্কৃত ভাষা চর্চা করেছিলেন । তবে ছকবাঁধা পড়াশােনা করতে নানকের মােটেই ভালাে লাগত না । একদিন শিক্ষককে তিনি বললেন শুন পাণ্ডে ক্যায়া লিখে জঞ্জালা লিখে রামনাম গুরু মুখ গােপালা । অর্থাৎ হে পণ্ডিত , আমাকে কী বাজে লেখাপড়া শিক্ষা দিচ্ছেন , গুরুমুখ দ্বারা একমাত্র রামগােপালের নামই শিক্ষণীয় ।এখানেই পড়াশােনার ইতি হয়ে গেল নানকের । আবার তিনি ভাব জগতে বিচরণ করতে লাগলেন । পুত্রের এহেন অবস্থা দেখে পিতা খুবই চিন্তিত হয়েছিলেন । পুত্রের ভবিষ্যৎ চিন্তা করতে করতে তিনি ভাবলেন , ছেলেকে যদি ব্যবসার কাজে লাগানাে যায় , তাহলে হয়তাে তার । নিরাসক্তিভাব দূর হবে । তিনি একদিন ছেলের হাতে কিছু টাকা দিলেন । বললেন— “ লবণের ব্যবসা করার জন্য লবণ কিনতে হবে । সঙ্গে একজন পরিচারককেও দিয়ে দিলেন । ” নানক সেই পরিচারককে সঙ্গে নিয়ে পথে বেরােলেন । কিছুদূর যাবার পর গাছতলায় কয়েকজন সাধুকে দেখতে পেলেন । সাধু - সন্ন্যাসী দেখলেই নানকের মন ছটফট করত । সব কাজ তিনি ভুলে যেতেন । সেবারও একই ঘটনা ঘটল । তিনি সাধুদের পাশে বসে পড়লেন । তাদের মুখনিঃসৃত অমৃতবাণী শ্রবণ করে অশেষ তৃপ্তি লাভ করলেন । কথায় কথায় জানতে পারলেন এইসব সাধু - সন্ন্যাসীরা ক্ষুধার্ত । নানক সঙ্গে সঙ্গে বাবার দেওয়া টাকা দিয়ে খাবার কিনলেন । সব টাকা খরচ করে সাধুদের সেবা করলেন । ভৃত্য বারবার আপত্তি জানাচ্ছিল । নানক রেগে গিয়ে বললেন— “ শােনাে , আমরা ব্যবসা করে কিছু টাকা লাভ করব , সেই টাকা দিয়ে আমরা সংসার ভরণ পােষণ করব , কিন্তু সে লাভ কি আমাদের মনে আনন্দ দিতে পারবে ? সে যে হল ঐহিক লাভ , আর সাধু সেবার টাকা খরচা করলে আমরা যে লাভ করব , সেটা হল পারমার্থিক লাভ । এখন তুমিই বলাে , আমি কোন্ লাভ করতে বেশি আগ্রহী হব ? ” ভৃত্য এতসব বুঝতে পারল না । বাড়ি ফিরে আসার পর সে নানকের পিতার কাছে সব কথা খুলে বলল । পিতা কালুবেদি পুত্রের এহেন কার্যাবলীর কথা শুনে ভীষণ রেগে গেলেন । তিনি নানককে গালাগাল দিলেন । কিন্তু কাজের কাজ কিছু হল না । পিতা ভাবলেন নানককে অন্য কোনাে কাজে নিযুক্ত করতে হবে । এবার তার ওপর আর একটি গুরু দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হল । বলা হল — গৃহপালিত গরু - মােষকে চড়াতে নিয়ে যেতে হবে । নানক মহানন্দে রাখাল রাজা সেজে গুরু - মােষের সঙ্গে অরণ্য প্রান্তরে পৌঁছে গেলেন । সেখান থেকে এলেন চারণভূমিতে । প্রথম কদিন কাজে কোনাে গাফিলতি হল না । তারপর নানক আবার প্রকৃতির রাজ্যে হারিয়ে গেলেন । মাঝে মধ্যেই ধ্যানমগ্ন অবস্থায় পৌঁছে গেলেন । আর গরু - মােযরা প্রতিবেশীদের জমিতে ঢুকে মনের সুখে শস্য নষ্ট করতে থাকল । প্রতিবেশিরা দলে । দলে এসে কালুবেদির কাছে অভিযােগ দায়ের করতে থাকলেন । কালুবেদি বুঝতে পারলেন এই কাজও নানকের দ্বারা হবে না । এখন কী হবে ? শেষ পর্যন্ত স্বামী - স্ত্রী পরামর্শ করে ঠিক করলেন । ছেলের বিয়ে দিতে হবে । বিয়ে দিলে ছেলে সংসারের প্রতি আগ্রহী হবে । আর এইভাবে ঘুরে বেড়াবে না । অনেক চিন্তাভাবনা করে গুরুদাসপুর জেলার বাতালা গ্রামের রূপবতী কন্যা সুলখনীর সাথে নানকের বিয়ে দেওয়া হল । তখন নানকের বােন জানকী তার স্বামী জয়রামকে অনুরােধ করলেন , যে করেই হােক নানকের জন্য একটি চাকরির ব্যবস্থা করতে । এতদিন । নানক একলা ছিলেন । এবার তার বিয়ে হয়েছে , এখন স্ত্রীর কথা ভাবতে হবে । জয়রাম নবাবের অধীনে কাজ করতেন । তারই প্রয়াসে নানক সেখানে চাকরি পেলেন । কিন্তু নানক এই কর্মজীবনে নিজেকে আবদ্ধ রাখবেন কী করে ? তিনি সাধারণ মানুষের মুক্তির পথ চিন্তা করছেন । সব সময় ভাবছেন । দুঃখে জর্জরিত মানুষের কথা । ভাবছেন কিভাবে সকল ধর্মের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে মানবতাবাদী একটি নতুন ধর্মের প্রবর্তন করা যায় । তিনি কি এইভাবে বিষয় কর্মে যােগ দিতে পারেন ? তিনি কি দপ্তরে কাজ করতে পারেন ? তখন সুলতানি আমলের শেষ অবস্থা । অস্তাচলে চলে গেছে তাদের গৌরব সূর্য । যে কোনাে সময় মােঘলরা ভারতবর্ষের ওপর ঝাপিয়ে পড়বে , শােনা যাচ্ছে তাদের পদধ্বনি । নানকের জীবদ্দশাইে বাবর দিল্লি অধিকার করে ভারতের সম্রাট হয়েছিলেন । তখন হিন্দুধর্মে দেখা দিয়েছে নানা বিপর্যয় । ব্রাহ্মণদের প্রভাব প্রতিপত্তি আগের থেকে আরও বেড়ে গেছে । হিন্দুদের ওপর মুসলমানদের লাঞ্ছনাও তখন । বড়াে কম ছিল না । এসব কথা চিন্তা করে নানক ভাবলেন , হিন্দু ও মুসলমান ধর্মের সার কথা নিয়ে নতুন একটি ধর্মমত প্রচার করতে হবে । সেই ধর্মে মানুষে মানুষে কোনাে বিভেদ বিভাজন থাকবে না । সেই ধর্মে কোনাে একটি সম্প্রদায়ের হাতে সবকিছু ছেড়ে দেওয়া হবে না । সুলতানপুরে থাকাকালীন তার সাধনজীবনে পূর্ণতা এসেছিল । মাঝে মধ্যে তিনি পাশের অরণ্যে গিয়ে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় সময় কাটাতেন । এই সময় নানক এক সদগুরুর সন্ধান পেয়েছিলেন । ওই মহাত্মা মানুষের সংস্পর্শে তার জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল । কিন্তু কে তার সদ্গুরু হয়েছিলেন , সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে নানক নীরবতা পালন করেছেন । হয়তাে কোনাে কারণে তিনি তার সদ্গুরুর নাম সকলের কাছে । প্রকাশ করতে চাননি । তবে তিনি যে একজন গুরুর আশ্রয় লাভ করেছিলেন সে কথা । বারবার স্বীকার করেছেন । তিনি বলেছেন , সগুরুর আশ্রয় লাভ এবং গুরু নির্দিষ্ট পন্থায় নামসাধন করাই ভগবত প্রাপ্তির প্রধান উপায় । সুলতানপুরে তার পত্নীকেও নিয়ে গিয়েছিলেন । কয়েক বছরের মধ্যে নানকের দুটি পুত্রসন্তানের জন্ম হয় । তারা হল শ্রীচাদ ও লক্ষ্মীচাদ । ধীরে ধীরে নানকের চার পাশে ক্ষুদ্র ভক্তমণ্ডলী গড়ে উঠল । কাজকর্মের শেষে গৃহে ফিরে নানক ভজনে ব্যস্ত থাকতেন । মাঝে মধ্যে ভক্তদের সাথে আধ্যাত্মিক আলােচনা করতেন । স্বতঃস্ফূর্তভাবে আধ্যাত্মিক তত্ত্বকথা নিয়ে ব্যাখ্যা করতেন । কিন্তু এভাবে একই জায়গায় বেশি দিন থাকবেন কী করে ? শেষ পর্যন্ত একদিন অন্তরের প্রেরণায় তিনি গৃহত্যাগী হলেন । বিভিন্ন শহর এবং গ্রামে ঘুরে বেড়ালেন । ভজন গানের মধ্যে দিয়ে নিজ ধর্মের কথা সকলের কাছে পৌছে দিলেন । এইভাবেই এক নতুন ভক্তিধর্মের । ৭৮ জন্ম হল । এই ধর্মকেই বলা হয় শিখধর্ম । নানকের ধর্মমত গ্রহণ করে যারা স্ব - ইচ্ছায় তার শিষ্যত্ব গ্রহণ । করেছিলেন তারাই হলেন আদি শিখ । নানক শিষ্য সম্প্রদায়ের কর্তা হয়ে গুরু উপাধি লাভ করেন । তাই তিনি হলেন গুরু নানক । শিখ ধর্মাবলম্বীদের দশজন ধর্মগুরু ছিলেন— ( ১ ) গুরুনানক , ( ২ ) নানকের শিষ্য অঙ্গদ , ( ৩ ) অঙ্গদের শিষ্য অমরদাস , ( ৪ ) অমরদাসের শিষ্য ও জামাতা রামদাস , যিনি অমৃতসরে গুরুদুয়ারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন , ( ৫ ) রামদাসের পুত্র অর্জুন , ইনি গুরু নানক এবং অন্যান্য গুরুদের বাণী সংগ্রহ করে ‘ গ্রন্থ সাহিব ’ বা আদি গ্রন্থ সংকলন করেন । এটি হল শিখদের কাছে । অত্যন্ত পবিত্র গ্রন্থ । ( ৬ ) অর্জুনের পুত্র হরগােবিন্দ । তিনি শিখদের মধ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রথম তলােয়ার ধারণ করেছিলেন , ( ৭ ) । হরগােবিন্দের পুত্র হররায় , ( ৮ ) হররায়ের পুত্র হরকিষণ , ( ৯ ) তেগবাহাদুর , ( ১০ ) তেগবাহাদুরের পুত্র গুরু গােবিন্দ । ইনি শিখদের একটি গিয়েছিল । আধুনিক যােদ্ধ জাতিতে পরিণত করেন । এনার পর গুরুপদ উঠে । নানক মাঝে মধ্যে অলৌকিক ক্ষমতা প্রকাশ করতেন । দিকে দিকে তার বাণী প্রচারিত হল । ঘুরতে ঘুরতে নানক পাঞ্জাবের বাতালাতে এসে । উপস্থিত হলেন । রাভি নদীর তীরে এক গাছের তলায় বসে আপন মনে ঈশ্বরের আরাধনা করছিলেন । তিনি উদাত্ত গলায় গান গাইছিলেন । মনে হল স্বয়ং ঈশ্বর বুঝি সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন । তার মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান — উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন । তাঁরা অবাক বিস্ময়ে । তাকিয়ে থাকলেন । বেশ বােঝা গেল , নানক তখন ঈশ্বরের ভাবে আবিষ্ট হয়েছেন । কিন্তু স্থানীয় জমিদার কড়ােরিয়া এই ঘটনায় মােটেই খুশি হলেন । একজন সামান্য সাধুর প্রভাব প্রতিপত্তি এতদূর বিস্তৃত হচ্ছে , তিনিতা সহ্য করবেন কেমন করে ? তিনি ভাবলেন , এই সাধুকে যথাযথ শিক্ষা দিতে হবে । এই সাধু যেন মাথা উঁচু করে বাঁচতে না পারে । তিনি নানাভাবে নানককে হেনস্তা করার চেষ্টা করেছিলেন । কিন্তু প্রত্যেকবারই নানকের । অলৌকিক শক্তির কাছে তাকে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছিল । শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে তিনি নানকের চরণে নিজেকে সমর্পণ করলেন । শুধু তাই নয় , সমস্ত গ্রামটি দিলেন নানককে । বললেন , নানক যেন এই গ্রামে থেকেই তার বাণী প্রচার করেন । অর্থাৎ এই গ্রামটি এখন থেকে নানকের প্রচার কেন্দ্র হিসাবে চিহ্নিত হবে । নানক এই দান গ্রহণ করেছিলেন । তিনি বলেছিলেন— “ এই সংসারে সমস্ত ভূমির মালিক হচ্ছেন কর্তা , তিনিই দৃশ্যমান সবকিছু সৃষ্টি করেছেন । আপনি ধন্য যে , তার নাম করে এই জমি তার কাছে বিলিয়ে দিচ্ছেন । আজ থেকে এই ভূমির নামকরণ করা হবে করতারপুর । ” শেষ অবধি করতারপুর হয়ে উঠেছিল নানকপন্থীদের অন্যতম । আস্তানা । শিখধর্ম প্রচারের প্রধান কেন্দ্র । নানক সমগ্র ভারত পরিভ্রমণ করেন । এই কাজ করতে গিয়ে তাহে যথেষ্ঠ শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিল । এবার তিনি এলেন ইসলাম - তীর্থ মক্কা - মদিনায় । সেখানে নানককে কেন্দ্র করে একটি আলােড়িত ঘটনা ঘটে গিয়েছিল । নানক মক্কায় এসে কাবা শরিফের পাশে খােলা মাঠের একধারে বিছানা পেতে বিশ্রাম করছিলেন । তার পা ছিল মসজিদের দিকে । কাবার মাতােয়ালির দৃষ্টি পড়ল এই ঘটনার দিকে । তিনি বললেন— “ ওহে দরবেশ , তােমার সাহস তাে বড়াে কম নয় , তুমি খােদার পবিত্র স্থানের দিকে তােমার পা রেখেছ ? ভালাে চাও তাে , এখনই তােমার পা সরিয়ে নাও । ” নানক তার কথা শুনলেন না । তিনি রহস্যময় হাসি হেসেবললেন- “ তাতে কী হয়েছে ?কোথায় ঈশ্বর নেই , বলাে তাে ? যেদিকে ঈশ্বর নেই , সেদিকে আমার পা টেনে সরিয়ে দাও না ভাই । ” রাগে অধীর হয়ে মাতােয়ালি নানকের পা দুটি টেনে ঘুরিয়ে দিলেন । কিন্তু তার চোখের সামনে একটি অবাক করা ঘটনা ঘটে গেল । মাতােয়ালি দেখেন , যেদিকেই পা দুটি ঘুরিয়ে দিচ্ছেন , সেখানেই কাবা মসজিদ অবস্থান করছে । এই অলৌকিক ঘটনা দেখে তিনি নানকের কথার আসল অর্থ বুঝতে পারলেন । সত্যিই তাে , স্থল - জল- অন্তরীক্ষ — সর্বত্রই ঈশ্বর বিরাজ করছেন । খােদা সর্বত্র বিরাজিত । আরও অনুভব করলেন এই অপরিচিত দরবেশ একজন মহাসাধক । তিনি নানকের পদতলে নিজের মস্তক স্থাপন । করলেন । নানক তাঁকে বুকে টেনে নিলেন । নানক দেশে দেশে পরিভ্রমণ করে নতুন ধর্মের কথা সকলের কাছে প্রচার করতেন । তার বাণী শুনে সকলেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু সকলের মনে একটি প্রশ্ন জেগেছিল । তা হল , উনি কোন্ সম্প্রদায়ের সাধু ? এই প্রশ্নের উত্তরে নানক বলেছিলেন , আমি নানক , অর্থাৎ নিরহঙ্কারী । নিরাকার সত্তা সমগ্র জগৎ সৃষ্টি করেছেন , আমি তারই ধ্যান করি । আমি তার মহিমা গেয়ে বেড়াই । আমার কাছে উঁচু - নীচুর মধ্যে কোনাে পার্থক্য নেই । আমার দৃষ্টিতে হিন্দু - মুসলমান বলে আলাদা কোনাে সম্প্রদায় নেই । আমি আন্তকিভাবে বিশ্বাস করি মানুষ ঈশ্বরের সন্তান , মানুষ অমৃতের পুত্র । ... পুণ্যবান এবং পাপী বলে কোনাে কিছু হয় না । অবিদ্যার ভ্রমে পাপ এবং পূণ্য বলে দু'ধরনের ভ্রান্তি আমাদের চোখের সামনে আসে । এই ভ্রমকে যে গ্রহণ করে সেই পাপ - পূণ্য দেখে । মানুষ নিজের কর্ম । করে এবং নিজেই তা বিচার করে । এ কেমন কথা ? ... পরমাত্মাই হচ্ছেন সমস্ত জীবের একমাত্র দাতা । পরমাত্মার মনন । ছাড়া আমরা কেউ শুদ্ধ চিত্ত লাভ করতে পারব না । নানক তার প্রিয় শিষ্য অঙ্গদকে দ্বিতীয় গুরর আসন প্রদান । করেছিলেন । শেষ অবধি ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে একাত্তর বছর বয়সে করতারপুরে রাভি নদীর তীরে তিনি মহানিদ্রায় মগ্ন হলেন । তার এই নিদ্রা আর ভাঙেনি । এবার আর একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেল । নানকের হিন্দু অনুগামীরা বললেন , তাঁকে দাহ করা হবে । আবার মুসলমান ভক্তশিষ্যরা বললেন , না , তিনি আচার - আচরণে ছিলেন ইসলাম অনুগামী , তাই তাকে কবরস্থ করা হবে । তখন নানকের মৃতদেহ বস্ত্রাচ্ছিদ ছিল । অবশেষে শেষ দর্শনের জন্য সেই বস্ত্রের আবরণ উন্মােচিত করা হল । উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে । দেখলেন , তার দেহ অলৌকিকভাবে অদৃশ্য হয়ে গেছে । শুধু পড়ে আছে । ওই বস্ত্রখণ্ডটি । বস্ত্রটিকে দুটি খণ্ড করা হল । একটি খণ্ড নিয়ে গিয়ে হিন্দুরা ইচ্ছামতাে সৎকার করলেন । অন্য খণ্ডটিকে মুসলমানরা সমাহিত করলেন । রাভি নদীর তীরে যেখানে নানকের মৃত্যু হয়েছিল , সেখানে একটি মন্দির এবং একটি সমাধি নির্মিত হয়েছে । রাভি নদীর প্লাবনে সেই মন্দির ও সমাধি ভেসে গেছে কিন্তু নানক প্রবর্তিত ধর্ম অও বেঁচে আছে ।


Power by © YogiKathaOfficial

www.yogsiddhi.in

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.