কালী আর কৃষ্ণকে যে আলাদাভাবে দেখে তাদের জ্ঞানের স্তরে অজ্ঞানতার পাঁচিল রয়েছে আমার কৃষ্ণ, আমার মহাপ্রভু কালী হয়েছিলেন ও রামচন্দ্র দুর্গা দেবীকে পূজা করেছিলেন ।
মা কালী ও শ্রীকৃষ্ণ |
পূর্বকালে গোলোকে রাসমণ্ডলে বসন্তকালে পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ সর্বপ্রথম দুর্গা পূজা করেছেন । দ্বিতীয়বার বিষ্ণু এবং পরে ব্রহ্মা দুর্গা পূজা করেছেন"। শরৎকালে অকাল বোধনের মাধ্যমে দুর্গা পূজা করেছেন ভগবান রামচন্দ্র । বৈষ্ণবদের সবথেকে প্রধান শাস্ত্র ভাগবত পুরাণে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ তাঁর যোগমায়া শক্তি দুর্গাকে বলছেন- তুমি পৃথিবীতে নানা নামে পূজিত হবে এবং ভক্তগণ তোমাকে নানা পূজা সামগ্রীর দ্বারা তোমার আরাধনা করবে। ( ভাগবত, ১০/২/ ১০-১২ ) । মহাভারতের যুদ্ধের পূর্বে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে দুর্গা স্তব করতে আদেশ করেন । ( মহাভারত, ভীষ্মপর্ব, ২৩/ ৪-১৬ ) ।
পরম বৈষ্ণব শ্রীজীব গোস্বামী ভাগবতের ব্যাখ্যায় বলেছেন,
-যঃ কৃষ্ণ সৈব দুর্গা স্যাৎ যা দুর্গা কৃষ্ণ এব সঃ ।।
শ্রী জীব গোস্বামী , ব্রহ্ম সংহিতা -টীকা -ধৃত গৌতমীয় কল্পবচন )। অর্থাৎ যে কৃষ্ণ , সেই দুর্গা । যে দুর্গা , সেই কৃষ্ণ ।। উহারা অভিন্ন । শক্তিমান ও শক্তি যেমন অভিন্ন, সেই ভাবেই, কৃষ্ণ ও দুর্গা এক ও অভিন্ন । তিনি আরও বলেছেন - অতঃ স্বয়মেব শ্রীকৃষ্ণস্বরূপ শক্তিরুপেন দুর্গানাম -অর্থাৎ শক্তিরূপিণী দুর্গার নামই স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণস্বরূপ।
স্বয়ং নিত্যানন্দ প্রভুর বাড়িতে আজও জাঁকজমকের সহিত দুর্গা পুজা হয় । স্বয়ং মহাপ্রভু মা দুর্গার রুপ ধরে ভক্তদের দর্শন দিয়েছেন।( চৈতন্য ভাগবত ,১৮ অধ্যায় )।
খ্রিস্টিয় ষোড়শ শতাব্দীর সময়কালে শ্রীচৈতন্যের কৃষ্ণনামের বন্যায় যখন "শান্তিপুর ডুবু, নদে ভেসে যায়", তখন তাঁর বিপরীতে ছিলেন এক প্রসিদ্ধ তন্ত্রসাধক, নাম---কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ (তার শিষের নাম রামপ্রসাদ). শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক এই তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ শ্রীচৈতন্যের মতো নবদ্বীপেই থাকতেন। নদীয়া জেলার নবদ্বীপের পোড়া মা তলায় রয়েছে "আগমবাগীশের কালী।" কিন্তু কেমন করে বাঙালির এই কালীর রূপ প্রতিষ্ঠিত হলো, সে কথা জানতে আমাদের পাড়ি দিতে হবে নবদ্বীপ।
মা কালী তখনও নিরাকারেই পূজিতা হচ্ছেন।
কৃষ্ণানন্দের ইচ্ছে, তিনি মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তিতে পুজো করবেন।
কিন্তু কেমন হবে মায়ের সেই রূপ?
সেই রূপের হদিশ পেতে শ্মশানে ধ্যানে বসলেন কৃষ্ণানন্দ।
দৈববাণী হলো, আগামীকাল ভোরে সবার আগে তুমি যে নারী মূর্তি দেখবে, সেই রূপেই পূজিতা হবো আমি।
দেখতে দেখতে রাত কেটে ভোর হয়ে গেলো।
কৃষ্ণানন্দ চললেন গঙ্গা স্নানে।
পথে দেখলেন, অন্ত্যজ বর্ণের একটি মেয়ে। গায়ের রং ঘোর কালো। মেয়েটির এক পা মাটিতে, অন্য পা দাওয়ায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে। ডান হাতে এক তাল গোবর, দেওয়ালে ঘু়ঁটে দিচ্ছে। বাঁ হাত দিয়ে প্রলেপ দিচ্ছে গোবরের। মাথায় একরাশ খোলা ঘন কালো চুল। পরণে উঁচু করে পরা ছোট্ট শাড়ি। এত ভোরে কৃষ্ণানন্দকে দেখে লজ্জায় জিব কাটলো মেয়েটি।
কৃষ্ণানন্দ বুঝে গেলেন এই হলো তবে মায়ের রূপ। এই রূপেই মাতৃপুজো করলেন কৃষ্ণানন্দ। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের এই রূপেই বাঙালির কালী আজ পূজিতা। তবে কৃষ্ণানন্দের কালীরূপের সঙ্গে পুরাণের অনেক কাহিনী যুক্ত হয়ে গেছে। তাই আগমবাগীশের কালীমূর্তির সঙ্গে আজকের কালীমূর্তির কিছু পার্থক্য দেখা যায়। বাঙালির কালী হলেন শ্যামাকালী।
তবে সাধক রামপ্রসাদ বলেছেন, মায়ের পায়ের তলায় শিব নন, পড়ে আছে শব। রামপ্রসাদ বলছেন, -----
"শিব নয় মায়ের পদতলে।
ওটা লোকে মিথ্যা বলে। ।
দৈত্য বেটা ভূমে পড়ে।
মা দাঁড়াবে তাহার উপরে। ।
মায়ের পদস্পর্শে দানবদেহ।
শিবরূপ হয় রণস্থলে। ।"
রামায়ণ-মহাভারতেও রয়েছে কালী বৃত্তান্ত। মহাভারতে আমরা পাই দুর্গা, কাত্যায়ণী ও ভদ্রকালীর কথা। অন্যদিকে, রামায়ণে রাবণপুত্র মেঘনাদ যে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে যজ্ঞ করার সময় লক্ষ্মণ সে যজ্ঞ পণ্ড করে দিয়েছিলেন, সেই দেবী নিকুম্ভিলা হচ্ছেন আসলে ভদ্রকালী। ড: শশীভূষণ দাশগুপ্ত তাঁর "ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্তসাধনা" গ্রন্থে জানাচ্ছেন, সুপ্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত গুহ্যসাধনার সঙ্গে শৈব ও শাক্ত মতবাদের মিশ্রণে জন্ম নিয়েছে শৈবতন্ত্র, শাক্ততন্ত্রের ধারা। বৌদ্ধধর্মীয় ভাবনার সঙ্গে মিশে গেছে শাক্ত প্রভাব। এইভাবে জন্ম হয়েছে বৌদ্ধতন্ত্রের, বৈষ্ণবধর্মের সঙ্গে মিশে জন্ম নিয়েছে বৈষ্ণব সহজিয়া ধর্মের।
উপরোক্ত চিন্তাভাবনা থেকে জন্ম নিয়েছে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীকেন্দ্রিক ধর্মধারার প্রাধান্য রয়েছে বলে নারীকে আনা হয়েছে কেন্দ্রবিন্দুতে। দেবীর নগ্নতা ( মা কালী) বহন করছে আদিম ধর্মধারার স্মৃতিকে। নারীসূচক দেহচিহ্নগুলিকে, যেগুলি অতীতের মানুষের বিষ্ময় মিশ্রিত জিজ্ঞাসা ও শ্রদ্ধার কারণ, সেগুলিকে সুস্পষ্টভাবে দেখানোর প্রয়োজনীয়তা মানুষ ভেবেছে।
সব হিন্দু দেবদেবীর গায়ের রং হয় গৌরবর্ণ কিংবা শ্বেত বর্ণ। একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছেন কালী। তাঁর গায়ের রং কালো। মহাকালের জন্মদাত্রী বলে কালী কালো। কালীর জিবের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, এটি সংযমের প্রতীক। ইন্দ্রিয় সংযমের আগে দরকার বাক্ সংযম এবং এজন্য দরকার জিবকে বশে আনা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমরা দাঁত দিয়ে জিব কামড়ে ধরলে কথা বলতে পারি না। সুতরাং, এখানে বাক সংযমের কথাই আসে। আবার বেদের সংহিতা ও ব্রাহ্মণে অগ্নি অর্থাৎ আগুনকে বলা হয়েছে "সপ্তজিহ্বা।" অগ্নি সর্বগ্রাসী। অগ্নিতে আহুতি না দিলে কোনো ফল হয় না। তাই অগ্নিতে আহুতি দেওয়ার নিয়ম।
বিধর্মীদের আক্রমণের বিরুদ্ধে বাঙালি শক্তি পেয়েছে দেবী কালীর কাছে। শাক্ত সাধকদের রণহুংকারে কেঁপেছে ঘন অরণ্যের মাঝে শক্তিসাধনার মাটি। নরবলির আতঙ্কে দিনে-দুপুরে তুর্কি আক্রমণকারীর দলের লোকজন পর্যন্ত মাতৃসাধকদের কালীস্থানগুলোকে সভয়ে এড়িয়ে চলতো। উদ্যত খাঁড়া হাতে অরণ্যে বীরদর্পে ঘুরে বেড়াতেন মা কালীর ভক্ত সাধকরা।
মহামায়া যদি কৃপা না করে ভিতরে প্রবেশ করার কোন ব্যবস্থাই নেই।
একজন সদগুরুর দেখানো পথে যদি কেউ কৃষ্ণ ও কালী কে সামনে রেখে গুরু ভজন করে তার ঐ সাকার কখন নিরাকারে পৌঁছে যায় শুধুমাত্র অনুভবের দ্বারা সাধক ই বলতে পারে বাইরে আমরা বিভেদ সৃষ্টি করেছি কিন্তু ভিতরে গিয়ে সবকিছু একাকার হয়ে গেছে আমার গুরু কৃপায় । l
কালীকৃষ্ণ বিভেদ ভুলে যার যার ইষ্ট কে সামনে রেখে গুরু চরণ ধরে দুর্লভ মানব জীবনে আধ্যাত্মিক পথে এগিয়ে যাওয়াটাই একজন বুদ্ধিমান সাধকের কাজ।
🙏 জয় গুরুদেবের জয় 🙏